গন্তব্য কুষ্টিয়া
১৮ অক্টোবর বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সহপাঠী কাজল আমাকে খুদে বার্তায় কুষ্টিয়া যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করল। বিলম্ব না করে মুহূর্তেই রাজি হয়ে গেলাম। লালন শাহর তিরোধান উপলক্ষে কুষ্টিয়ায় ৩ দিনব্যাপী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। কাজল থাকে ঢাকায় আর আমি থাকি ভৈরবে। ১৯ তারিখ ভোর পাঁচটায় ভৈরব বাজার জংশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। প্রথমে গেলাম কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। সেখানে দুজন মিলিত হয়ে কুষ্টিয়ার উদ্দেশে রওনা হলাম সকাল সোয়া ৮টায়।
দুপুরে পৌঁছালাম কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে আরও কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। তাঁরা সবাই মধ্যবয়সী। নাইম উদ্দিন এবং তাঁর সঙ্গে আছেন তিনজন। তাঁরা এসেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। এ ছাড়া আরও একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। নাম ফাহাদ। তিনি কুমিল্লায় কর্মরত আছেন। কাজল আর আমিসহ মোট ৭ জনের একটি দল গঠন হয়ে গেল।
সবার পরামর্শ অনুযায়ী প্রথমে রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত হলো। সেখান থেকে ফিরে বিকেলে যাব লালন মেলায়, এমনটাই স্থির করলাম। একটা অটোরিকশায় চড়ে আমরা গড়াই নদের ওপর দিয়ে চললাম কুঠিবাড়ির উদ্দেশে। ড্রাইভার বললেন, ‘আপনারা কুমারখালী স্টেশনে নেমে পড়লেই পারতেন। তাতে দূরত্ব কম হতো।’
পিচঢালা পথের দুই পাশে ক্ষুদ্র গ্রামগুলো দেখতে দেখতে কুঠিবাড়ি চলে এলাম। প্রবেশপথের দুই ধারে বেশ কিছু দোকান চোখে পড়ল। নয়নাভিরাম তৈজসপত্রে দোকানগুলো ঠাসা হয়ে আছে।
টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলাম বিশাল এলাকা! রবীন্দ্রমঞ্চ, রেস্টহাউস, ক্যানটিন প্রভৃতি ভবন চোখে পড়ল। কুঠিবাড়ির দেয়ালগুলো যেন নদীর ঢেউ। অপূর্ব কারুকাজসমৃদ্ধ বাড়িটি দেখলেই চোখ জুড়ায়। রবীন্দ্রনাথের সময়ে ব্যবহৃত দুই হাতল বিশিষ্ট বেঞ্চ, আলমারি, খাট, লোহার সিন্দুক, ঘাস কাটার যন্ত্র, পানি পরিশোধন করার যন্ত্র কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে। তাঁর শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের ছবি দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। পরিবারের ছবিগুলোর মধ্যে তাঁর পিতা, পিতামহ, সন্তানসন্ততি, পত্নী মৃণালিনী দেবী এবং বউদি কাদম্বরী দেবীর ছবিও ছিল। আট এবং ষোলো বেহারার দুটি পালকি পাশাপাশি রাখা। রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা কবিতার অংশ, ইংরেজি চিঠি এবং তাঁর কিছু চিত্রকর্ম দেখলাম। বাড়ির পশ্চিম পাশে পুকুর। পাড়ে বসার জন্য আসনের ব্যবস্থা।
ঘুরে ঘুরে নিজেরা বেশ কিছু ছবি তুললাম। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে দুপুরের খাবারের জন্য একটা ভাতের হোটেলে প্রবেশ করলাম। স্যাঁতসেঁতে টেবিল আর প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সবাইকে তৃপ্তির সঙ্গে খাবার খেতে দেখা গেল।
খাওয়া শেষে আবারও অটোরিকশায় চড়লাম লালন মেলার উদ্দেশে। ঘড়িতে তখন বেলা ৩টা বেজে ৪০ মিনিট। মেলায় এসে এত মানুষের সমাগম দেখে ভাবছিলাম, সন্ধ্যা হলে এই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাবে কি না!
লালন শাহর মাজারের কাছে কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম। কোথাও গান হচ্ছে, কোথাও হচ্ছে সাধনা। তাপস ও তপস্বিনীদের সম্মিলিন এভাবে আর কোথাও দেখিনি। বাউলদের বসার জন্য অডিটরিয়াম রয়েছে। সেখানে ভক্তবৃন্দ শয্যার ব্যবস্থা করে পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। কেউ কেউ গানের ভাবার্থ বোঝার চেষ্টায় স্থির হয়ে বসে অপলক চেয়ে আছে। চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে নামছে। সাদা দাড়ি আর বাহারি লম্বা গোঁফ। বড় আকারের লাল রঙের পুঁথি দিয়ে বানানো মালাগুলো গলায় শোভা পাচ্ছে। কারও মাথায় লম্বা চুল। এসব দেখতে দেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকের আনাগোনাও ছিল চোখে পড়ার মতো।
সেখান থেকে বেরিয়ে মেলার আশপাশটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। খাবার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান অধিক। খাবারের দোকানগুলো বেশ পরিচ্ছন্ন। শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা বেশ স্বস্তিদায়ক ছিল। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল গানের আয়োজনগুলো। নবপ্রাণ আন্দোলন আখড়া বাড়িতে গানের অনুষ্ঠানের ব্যানারে লিখা ছিল, ‘পারে লয়ে যাও আমায়’। দলছুট হয়ে আমি আর কাজল সেখানে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করেছিলাম।
খালের পাশে চিকন একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে মাদকের অত্যধিক ছড়াছড়ি দেখে মনে মনে বেশ আহত হয়েছিলাম। এরপর আবারও অডিটরিয়ামে ফিরে এলাম। সেখানে একটি দলকে গানে সুর দিতে দেখলাম। একতারা, ঢোল, হারমোনিয়ামের তালে দুষ্টু বালকেরা কণ্ঠ মিলিয়ে জোরালো আওয়াজ তুলছে, ‘হেহ, হেহ হু’। আবার চিৎকার করে তারা বলে, ‘হেইয়্যো’! বাকিরা কণ্ঠ মেলায়। অনেকেই হেসে ওঠে। সে এক বিচিত্র দৃশ্য।
অনেক বেশি ক্লান্ত লাগছিল। ঘড়িতে তখন রাত ১টা। একটা ভ্যানের ওপর শুয়ে ফেরার ট্রেনের অপেক্ষা করছি। পাশে বসে কাজল তার জীবনসম্পর্কিত নানা ভাবনা প্রকাশ করছে। মাঝরাতেও স্টেশনটা কেমন লোকারণ্য হয়ে আছে।