বাংলাদেশ টেলিভিশনের আয় বাড়াতে পারে যেভাবে
দৈনিক প্রথম আলোতে ৩ অক্টোবর ‘বিটিভি আগে কী দেখাত, এখন কী দেখাচ্ছে’ নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদক সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের লেখনিতে নব্বই দশকের শেষে ফিরে যাচ্ছিলাম পাঠক হিসেবে। আহা, বিটিভির সেই সব দিনরাত্রি। ম্যাগাজিন ইত্যাদি, মুভি অব দ্য উইকের সিনেমা, সাপ্তাহিক নাটক, নতুন কুড়ি, শুভেচ্ছা, বিভিন্ন বিদেশি অনুষ্ঠানের ভাষান্তর প্রচার থেকে কবে যে বিটিভি ‘বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
আমাদের বাংলাদেশ টেলিভিশন, সবার কাছে বিটিভি নামেই যার পরিচয়। এশিয়ার অন্যতম পুরোনো টেলিভিশন স্টেশন বিটিভি। ১৯৬৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে দেশের ১৮ কোটি বেশি দর্শকের সামনে সরকারি চ্যানেল হিসেবে নিজের পরিচয় বজায় রেখেছে। বিটিভির অনুষ্ঠানমালা ও প্রচার ভাষ্য আজও দেশের আধুনিক সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত বলা যায়। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে হলে আর টেলিভিশন চ্যানেল হিসেবে আর্থিক স্বাবলম্বিতার দিকে এগোতে হলে বিটিভিকে তার আয়ের উৎস বাড়াতে হবে। বর্তমানে বিটিভি প্রধানত বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল। তবে, উন্নত অনুষ্ঠানমালা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ প্রতিষ্ঠানটির আয়ের নতুন নতুন পথ উন্মোচিত করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সৃজনশীলতা, বাজার বিশ্লেষণ এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ।
বিটিভির আয়-ব্যয় কেমন
২০১৬ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিজ্ঞাপন বাবদ ২০১১-১৬ সময়ে বিটিভির আয় অর্ধেকে নামতে দেখা যায়। ২০১০-১১ অর্থবছরে বিটিভির বিজ্ঞাপন আয় ছিল ১১৭ কোটি, তা কমতে কমতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫২ কোটি টাকায় ঠেকে। ২০১০-১১ অর্থবছরে বিটিভির লোকসান ছিল ৪৩ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লোকসান বেড়ে যায় ১০১ কোটি টাকা। বিটিভির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২১-২২ অনুসারে, ২০২০-২১ সালের বিটিভির মোট রাজস্ব আয় হয় প্রায় ৩৪ কোটি টাকা। আর ব্যয় হয় ২৮০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ সালে আয় ২৯ কোটি টাকা, ব্যয় ২৬০ কোটি টাকা। যে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন জনগণের অর্থে হচ্ছে, সেখানে আয় বাড়ানোর সুযোগ থাকলেও বসে থাকে কর্তৃপক্ষ। কেন?
অনুষ্ঠানের মান বাড়লে বিজ্ঞাপনে রাজস্ব বাড়বে, আছে বিকাশের সুযোগ
বিটিভির অনুষ্ঠানের মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেল এখন উন্নতমানের অনুষ্ঠান তৈরি করে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বিটিভির অনুষ্ঠানের মান উন্নত করতে হবে। উন্নত অনুষ্ঠান দর্শকদের বেশি আকর্ষণ করে, যা বিজ্ঞাপনের আয় বৃদ্ধির পথ খুলে দেয়। ভারতের দূরদর্শন এই ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হতে পারে। দূরদর্শন ধীরে ধীরে অনুষ্ঠানমালার মান উন্নয়ন করে নতুন বিজ্ঞাপনদাতাদের আকর্ষণ করেছে। ইউটিউব-ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া মনিটাইজেশনের সুযোগ ভালো করে কাজে লাগানোর সুযোগ আছে।
টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন
বিটিভির ৬০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা ও দক্ষ কর্মী বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে টেলিভিশন প্রযোজনায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন জাপানের এনএইচকে টেলিভিশন তাদের অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এ ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিটিভি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন-ফি গ্রহণ করে একটি বড় আয়ের উৎস তৈরি করতে পারে।
বিটিভির স্টুডিও ভাড়া দেওয়ার সুযোগ আছে
বিটিভির নিজস্ব স্টুডিও এবং প্রযুক্তিগত সরঞ্জামগুলোর মান অনেক উন্নত। এ ধরনের স্টুডিওগুলোতে বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান, সিনেমা বা ডকুমেন্টারি শুটিংয়ের জন্য ভাড়া দেওয়া যেতে পারে। ভারতীয় চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি এই ধরনের ভাড়া-নির্ভর মডেল অনেক আগেই গ্রহণ করেছে ও সফল হয়েছে। এফডিসি যেমন তাদের স্টুডিও ভাড়া দিয়ে আয়ের বড় উৎস তৈরি করেছে, বিটিভিও একই পথ অনুসরণ করতে পারে।
মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালুর সুযোগ
বিটিভি তার ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে সাংবাদিকতা বিষয়ে একটি মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করতে পারে। জার্মানির ডিডাব্লিউ রেডিও বা বিবিসিতে এই ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়। এতে মিডিয়া শিক্ষায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। বিটিভিও এই মডেল অনুসরণ করতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা অনলাইন ও অফলাইনে পাঠ গ্রহণের সুযোগ পাবে। এটি শুধু বিটিভির আয়ের নতুন উৎসই হবে না, বরং দেশের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ্য ও দক্ষ কর্মী বাহিনী তৈরি করতে সাহায্য করবে।
আর্কাইভ থেকে আয়ের সুযোগ
বিটিভির আর্কাইভে অনেক পুরোনো অনুষ্ঠান, সংবাদ এবং ইতিহাসমূলক ফুটেজ সংরক্ষিত রয়েছে, যা বিভিন্ন গবেষক, ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য অমূল্য সম্পদ। আর্কাইভের এই দুষ্প্রাপ্য ফুটেজ নির্ধারিত ফিয়ের বিনিময়ে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে বিটিভি আয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে, বিবিসি তাদের আর্কাইভ ফুটেজ ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত আয়ের বড় অংশ সংগ্রহ করছে।
বিটিভির পত্রিকা বা ম্যাগাজিন প্রকাশ, বৈজ্ঞানিক জার্নাল প্রকাশ
বিটিভি মাসিক ম্যাগাজিন কিংবা একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে পারে, যেখানে তাদের অনুষ্ঠানমালা এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কার্যক্রম নিয়ে লেখা থাকবে। পত্রিকার মাধ্যমে সরকারি বিজ্ঞাপন এবং বেসরকারি স্পন্সরশিপের সুযোগ পাওয়া যাবে, যা বিটিভির আয়ের উৎস হতে পারে। ভারতের দূরদর্শন তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান–সংক্রান্ত ম্যাগাজিন প্রকাশ করে বিজ্ঞাপন আয়ের মাধ্যমে আর্থিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করেছে। বিটিভি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে বৈজ্ঞানিক জার্নাল প্রকাশে উদ্যোগ নিতে পারে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং ওটিটি সেবা
বর্তমান যুগে ডিজিটাল মাধ্যম আয়ের একটি বড় উৎস হয়ে উঠেছে। বিটিভি তার গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রচার করতে পারে। যেমন ভারতের দূরদর্শন বা এনএইচকে তাদের প্রোগ্রাম ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সম্প্রচার করে, যা তাদের আয়ের একটি বড় উৎস। ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন এবং ভিউভিত্তিক অর্থ আদায়ের মডেল ব্যবহার করে বিটিভি সহজেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজস্ব সেবা চালু করতে পারে।
কনটেন্ট সিন্ডিকেশন
বিটিভি বিভিন্ন বাংলাদেশ–সংক্রান্ত ডকুমেন্টারি, সংস্কৃতিভিত্তিক অনুষ্ঠান এবং তথ্যচিত্র তৈরি করে আন্তর্জাতিক টেলিভিশন স্টেশন বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করতে পারে। যেমন বিবিসি তাদের অনুষ্ঠানমালা সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলি নিয়ে নির্মিত অনুষ্ঠান বিদেশি দর্শকদের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে, যা বিটিভির আয়ের নতুন একটি পথ খুলে দেবে।
মার্চেনডাইজিং পণ্য বিক্রি
বিটিভির সদর দপ্তর প্রাঙ্গণে বা জেলাভিত্তিক কেন্দ্রে বিটিভির বিভিন্ন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান বা ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে মার্চেনডাইজিং পণ্য যেমন মগ, টি-শার্ট ইত্যাদি বিক্রি করা যেতে পারে। ডিজনি যেভাবে তাদের জনপ্রিয় চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করে বিশাল একটি বাজার তৈরি করেছে, বিটিভিও তার ব্র্যান্ডকে নতুনভাবে প্রচারের মাধ্যমে মার্চেনডাইজিং থেকে আয় করতে পারে। এটি দর্শকদের মধ্যে বিটিভির প্রতি আবেগ ও সংযোগ তৈরি করবে। বিটিভির একটি জাদুঘর আছে, তা দর্শনার্থীদের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়ে টিকিটের মাধ্যমে অর্থ আয়ের সুযোগ আছে।
স্পন্সরশিপ গ্রহণ
সাধারণভাবে বলা যায়, বিটিভি শুধু বিজ্ঞাপনের জন্য অর্থ গ্রহণ করে থাকে। তবে, অন্যান্য দেশি চ্যানেলের মতো বিটিভি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য স্পন্সরশিপ গ্রহণ করতে পারে। ভারতের জি টিভি বা সনি এন্টারটেইনমেন্ট যেমন রিয়েলিটি শো এবং বিভিন্ন ধারাবাহিকের জন্য স্পন্সরশিপ নিয়ে থাকে, বিটিভিও একইভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান স্পন্সর করে তা থেকে আয়ের পথ তৈরি করতে পারে।
নব্বই দশকে আমরা বিটিভি দেখা প্রজন্ম। ২০০৭-০৮ সাল পর্যন্তও আমাদের মিলেনিয়াল জেনারেশনের প্রধানতম বিনোদনের উৎস ছিল বিটিভি। বিটিভি একসময় দেশের একমাত্র টেলিভিশন স্টেশন ছিল, যেখানে দেশের মানুষ এক হয়ে ইত্যাদি কিংবা আলোচিত সব অনুষ্ঠান দেখত। আমরা বুঝি, সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও পরিবর্তিত প্রযুক্তির আবির্ভাবে বিটিভির টিকে থাকা এখন একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিটিভিকে তার ঐতিহ্যকে ধরে রেখে যুগোপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুন আয়ের উৎস ব্যবহার করে বিটিভি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে এবং আবারও দেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে নেতৃত্ব দিতে পারে।
লেখক: এমফিল গবেষক, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ই–মেইল: [email protected]
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]