মাহবুব সাহেব
ব্রেক চাপতে না চাপতেই গাড়ি ধাক্কা দেয় রিকশায়। রিকশাওয়ালা ছিটকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খায়। মাথা ফেটে দরদর করে রক্ত বের হতে থাকে। রিকশায় থাকা দুই যাত্রীও পড়ে যায়। তবে তাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। রিকশা গিয়ে রাস্তা ওপরে পার্ক করে রাখা হ্যারিয়ারে আঘাত করে। এতে চকচকে নিখুঁত গাড়িতে সামান্য স্ক্র্যাচ খায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যায় চালকের আসনে বসা মাহবুব সাহেব! গাড়ি দ্রুত থামিয়ে নেমে পড়ে সে। কোনো কিছু না ভেবেই আহত রিকশাওয়ালার দিকে দ্রুত যেতে থাকে। ততক্ষণে চারদিক থেকে উত্তেজিত লোকজন এসে মাহবুব সাহেবকে ঘিরে ধরে। কেউ কেউ গাড়ি ভাঙতে চায়, আবার কেউ গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করে এবং বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে থাকে। সবাইকে থামিয়ে দেয় সেখানে থাকা এক সবজি বিক্রেতা। সে বলে, ড্রাইভারের দোষ নেই। রিকশাওয়ালা হঠাৎ করে উল্টো দিকে চলে আসায় ধাক্কা খেয়েছে। সবজি বিক্রেতার কর্কশ কথা শুনে ক্ষিপ্ত পথচারীরা কিছুটা প্রশমিত হয়।
মাহবুব সাহেব শান্তশিষ্ট নিপাট ভদ্রলোক। এটা তার ব্যক্তিগত গাড়ি। ১০ বছর ধরে নিজেই ড্রাইভ করে কিন্তু এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে তাকে কখনো পড়তে হয়নি। আজ দুপুরে অফিস থেকে বের হয়েছে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশে। প্রথমে ভেবেছিল মিরপুর ১০ নম্বর হয়ে যাবে কিন্তু হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য ৬০ ফিটের সরু রাস্তা দিয়ে ঢোকেন। এই রাস্তা যেমন খানাখন্দে ভরা তেমন বেপরোয়াভাবে যানবাহন চলাচল করে। এ ধরনের দুর্ঘটনা এখানে প্রতিদিনই ঘটে।
যদিও এ দুর্ঘটনায় মাহবুব সাহেবের তেমন দোষ নেই। কিন্তু বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার রক্তাক্ত মাথা দেখে নিজের মধ্যে ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করে তার। সে মানুষের কথার তোয়াক্কা না করে দ্রুত ভিড় ঢেলে রিকশাওয়ালাকে ওঠাতে যায়। রিকশার দুই যাত্রীর সহযোগিতায় পাশের একটা ক্লিনিকে নিয়ে যায় প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য।
মাহবুব সাহেবের এমন সহমর্মিতার জন্য অত্যুৎসাহী উগ্র পথচারীরা শান্ত হয়ে চলে গেলেও রিকশার দুই যাত্রী নাছোড়বান্দার মতো তাঁর সঙ্গে লেগে থাকে। রিকশাওয়ালার শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে তারা তাকে যেতে দেবে না। বাধ্য হয়ে ক্লিনিকে অপেক্ষা করতে থাকে আহত রিকশাওয়ালার সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য।
বাইরে তীব্র শীত। প্রায় সাত দিন ধরে সূর্যের মুখ দেখা যায় না। এমন শীতে মাফলার দিয়ে নাকমুখ বেঁধে জড়সড় হয়ে বসে ফেসবুকে স্ক্রল করার চেষ্টা করে মাহবুব সাহেব, কিন্তু ভালো লাগে না। অবচেতন মনেই ফিরে তাকায় জীবনের পেছনে। শেষ দুই বছরে ধরে কী বিক্ষুব্ধ সময় পার করছে সে। প্রথমে বোনের সামান্য একটা অপারেশন করতে গিয়ে বিপত্তির শুরু হয়। প্রায় ছয় মাস জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে থাকে একমাত্র বোন। একই সময়ে ভগ্নিপতির হার্ট অ্যাটাক হয়। এক বছরের ছোট্ট যমজ ভাগনিদের দিকে তাকিয়ে কী অসম্ভব চেষ্টা করেছে বোনের জন্য। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং ডাক্তারদের নিরলস প্রচেষ্টায় বিপদ কেটে যায়। বোন সুস্থ হতে না হতেই বোন জামাইয়ের ওপেন হার্ট অপারেশন করাতে হয়। এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল করতে করতে সে ভুলেই গিয়েছিল কোনটা বাসা, কোনটা অফিস আর কোনটা হাসপাতাল।
তাদের সুস্থ করে বাড়িতে পৌঁছে দিতে না দিতেই মায়ের শরীর খারাপ হতে থাকে। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে মাকে চিকিৎসা করানোর জন্য ভারতে নিয়ে যায় মাহবুব সাহেব। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না। মাস তিনেক আগে তাঁর মা পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যায়। মাহবুব সাহেবের এক বন্ধু তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, মায়ের জীবনের বিনিময়ে হয়তো স্রষ্টা তোমার বোনের জীবন ফেরত দিয়েছেন। সে মনে মনে ধরে নিয়েছিল, সেটাই হয়তো ঠিক জীবনের বিনিময়ে জীবন ফেরত এসেছে।
যা-ই হোক এবার সে একটু বিশ্রাম নিতে চায়। কিন্তু বিশ্রাম তার জীবনে নেই। মায়ের শোক সামলে উঠতে না উঠতেই বাবার শরীর খারাপ হতে থাকে। মাস তিনেক ধরে বাবাকে গ্রাম থেকে বাসায় এনে চিকিৎসা করাচ্ছে। বাসায় একজন অসুস্থ মানুষ থাকলে কী পরিমাণ বিপদ, সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।
এর মধ্যে গত সপ্তাহে হঠাৎ করে শ্বশুর অসুস্থ হয়। একটু পরপর খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, জ্ঞান ফেরার পরে কাউকে ভালো করে চিনতে পারে না। শ্বশুরের কোনো ছেলে নেই, বড় জামাই হিসেবে সব দায়িত্ব তার কাঁধে। প্রথমে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ডাক্তার কিছু টেস্ট করে বলে ব্রেন টিউমার হয়েছে, দ্রুত অপারেশন করতে হবে। এ কথা সে সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী মনিকাকে বলতে পারে না। মনিকা দুর্বল হৃদয়ের মেয়ে, হঠাৎ এমন খবরে সে মানুষিকভাবে ভেঙে পড়বে। অন্য দুই বোন এলে সবকিছু খুলে বলবে। কিন্তু অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে। উপায়ান্তর না দেখে গতকাল নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। সেখানেও ডায়াগনোসিস রিপোর্টে টিউমার ধরা পড়েছে, যতটা দ্রুত সম্ভব অপারেশন করাতে হবে।
সকালে স্ত্রী মনিকা হাসপাতালে এলে মাহবুব সাহেব বাসায় যায়। তারপর গোসল সেরে সামান্য কিছু খেয়ে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে অফিসে যায়। দুপুরের দিকে নার্স এসে মনিকাকে রোগীর সর্বশেষ অবস্থা বিস্তারিত বলে। হঠাৎ বাবা সম্পর্কে এমন খবর শুনে হতবিহ্বল হয়ে যায় মনিকা। এদিকে রোগী বেড থেকে বের হয়ে যায়, তাকে সবাই খুঁজতে থাকে। এমন সময় নিরুপায় হয়ে মনিকা মাহবুব সাহেবকে ফোন দিয়ে পাগলের মতো কান্না শুরু করে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সে গাড়ি নিয়ে দ্রুত হাসপাতালের দিকে রওনা দেয়। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে চিন্তা করে, বাসায় বাবা অসুস্থ, হাসপাতালে শ্বশুর ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত, মেয়েটা একা স্কুল থেকে কীভাবে ফিরবে, অফিসে ঝামেলা হচ্ছে, তার নিজের শরীরটাও কিছুদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না।এত সব দুশ্চিন্তা করতে করতে সামান্য অসাবধান হয়ে যায় সে; ফলে এই দুর্ঘটনা।
মানুষের ব্রেন প্রতিটি কর্মের জন্য যুক্তি রুজু করে। নিজের এই যুক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি দেয় মাহবুব সাহেব, ড্রাইভিং সিটে বসে ভুল করার কোনো সুযোগ নেই! হঠাৎ মোবাইলে টুন শব্দে বাস্তবতায় ফিরে আসে সে। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে স্ত্রী টেক্সট পাঠিয়েছে, বাবাকে পাওয়া গেছে এবং ছোট বোন এসেছে।
এদিকে ক্লিনিকের ইমার্জেন্সি থেকে মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ নিয়ে বের হয় রিকশাওয়ালা। মাহবুব সাহেব হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে রিকশাওয়ালার হাতে তিন হাজার টাকা দিয়ে তাকে বাড়িতে যেতে বলে। রিকশাওয়ালার সঙ্গে থাকা এক যাত্রী এই ক্ষতিপূরণে সন্তুষ্ট হয় না। সে বলে, রিকশাওয়ালাকে আরও সাহায্য করতে হবে।
আর কীভাবে সাহায্য করব?
আপনার ফোন নম্বর তাকে দেন। সে যদি সুস্থ না হয় এবং পরে চিকিৎসার জন্য আরও টাকা লাগে, তাহলে সেটা আপনি পরিশোধ করবেন।
মাহবুব সাহেব ভাবে, এ কথায় যুক্তি আছে। রিকশাওয়ালা কীভাবে চিকিৎসার খরচ চালাবে। তাই পকেটে থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে রিকশাওয়ালাকে দিয়ে বলে, যদি কোনো সমস্যা হয় আমাকে জানাবেন।
ক্লিনিকের বাইরে এসে দেখে আরও দুজন তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। এদের একজন পার্ক করে রাখা হ্যারিয়ার গাড়ির ড্রাইভার। সঙ্গে আরেকজন দালাল টাইপের লোক। ড্রাইভার গাড়ির দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে, আমার গাড়িতে ঘষা লেগেছে এর জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
আপনার গাড়ি তো রাস্তার ওপরে অবৈধভাবে পার্কিং করা ছিল। আমার গাড়ির সঙ্গে আপনার গাড়ির ছোঁয়া লাগেনি, তাহলে ক্ষতিপূরণে কথা আসছে কেন?
আপনি রিকশায় লাগিয়ে দিয়েছেন। রিকশা গিয়ে আমার গাড়িতে লেগেছে, তাই আপনাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
দালাল টাইপের লোক হ্যারিয়ারের দাম, রং খরচ নিয়ে আস্ফালন করতে থাকে।
সবকিছু মিলিয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে মাহবুব সাহেব। বিরক্ত হয়ে বলে, আপনি কোনো এক গ্যারেজে গাড়ি ঠিক করে বিলটা আমাকে ধরিয়ে দিয়েন।
দালাল লোকটা বলে, আপনি যে টাকা দেবেন আমরা কীভাবে বিশ্বাস করব? সঙ্গে সঙ্গে ফোনের ভিডিও অন করে বলে, এবার বলেন ক্ষতিপূরণ দেবেন। তারপর মাহবুব সাহেবকে গাড়িসহ ভিডিও করে। ত্যক্ত-বিরক্ত ক্ষুধার্ত মাহবুব সাহেব বলে, আপনাদের যা ইচ্ছে করেন তবে এখন আমাকে যেতে দেন। হ্যারিয়ারের ড্রাইভার বিজয়ের হাসি দিয়ে বলে, এখন যেতে পারেন, তবে রাতেই আমি আপনার কাছে বিল নিয়ে চলে আসব।
মাহবুব সাহেব আর কথা বাড়ায় না, সোজা গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে। আস্তে আস্তে গাড়ি চলতে থাকে। কোনো এক অজানা শক্তি তাকে সব সময় হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়।
*লেখক: রূপক রেজা, মিরপুর, ঢাকা।
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]