বউ

বিয়েপ্রতীকী ছবি

হোসেন মিয়ার বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। বয়সের সঙ্গে তার মুখে কথার গতিও যেন বেড়েছে। বারান্দায় বসে প্রথম যে কথাটি সেটি হচ্ছে ‘আইজ সময় নাই, আইজ কোন কথা কইতাম না।’ কিন্তু তার মুখ একবার খুলে গেলে আর আটকায় কে। দুনিয়ার কথা তার কাছে। একটার পর একটা বেরিয়ে আসে। সব যেন মিহি সুতোর বুনন। এক ঘটনা আবার কখনো দুবারও বলে না। যদি বলেও ফেলে, সেটা ধরার কোনো উপায় থাকে না। কথা বলার কোনো প্রতিযোগিতা হলেও তাকে কেউ পেছনে ফেলার মানুষ পাওয়া যাবে, এমনটা ভাবনাতেও আসে না।  

একদিন আসরের নামাজের পর টুপি মাথায় হাজির হোসেন মিয়া। ‘দাদুর কথা বড় বেশি মনে পড়তাছিল তাই চইলা আইছি’—বাড়ির ভিতরে ঢুকেই হাঁক ছাড়ে সে। আয়নাল হাজির মাকে দেখতেই মূলত সে আসে এ বাড়িতে। ছোটবেলা থেকে এ বাড়িতে কাজ করে বড় হয়েছে সে। সে মায়া কাটাতে পারে না। বছরে একবার হলেও আসবে। আজ সে বসবে না। তার বাড়িতে কেউ নেই। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি তার জিম্মায়। সেগুলোকে ঘরে তুলতে হবে, খাবার দিতে হবে। এটা মস্ত বড় দায়িত্ব। কিন্তু দাঁড়িয়ে থেকেই শুরু হয়ে গেল কথার ঝড়। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। তার বাড়ির বর্ণনা আর সে এলাকার মানুষজনের আচার-আচরণ বলতে বলতে মাগরিবের আজান পড়েছে দূরের মসজিদে। এর মধ্যে হাজির মা বেশ কয়েকবার সতর্কও করে যে, ‘বাড়িত যা, খালি বাড়ি। আরেক দিন আইয়া সব কইস। এক দিনে সব গপ কইরা ফেলবি নাকি।’ ‘যামু যামু’ করে সে আবার নতুন করে গল্প শুরু করে। আজানটা শুনে হুঁশে ফিরে। কিন্তু কথা শেষ না করতে পারার আফসোস করতে করতে বাড়ি থেকে বের হয়ে তার নিজ বাড়ির দিকে গমন করে।

পর দিন সে আবার হাজির। এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। তিন চার মাস অন্তর অন্তর সে এদিকটায় আসে সাধারণত। গ্রামের মুরুব্বী যারা আছে সবাইকে এক নজরে দেখে যায়। মাইল তিনেকের পথ। পুরোটা আসে পায়ে হেঁটে। পিচ ঢালা রাস্তা, গাড়ি সবই আছে কিন্তু সেসবে আসা চলবে না। বাপ দাদারা মাইলের পর মাইল হেঁটেছে আগে। সে এখন এই অল্প রাস্তা গাড়িতে যাবে প্রশ্নই উঠে না। তাছাড়া গাড়ির প্রতি ভয়ও আছে যথেষ্ট। মরলে এভাবে মরবে, গাড়ির তলে পড়ে মরতে চায় না সে। কলকব্জার গাড়ি যখন তখন উল্টে যাওয়ার এক ভীতি তার। গতকাল রাতে চোর এসেছিল তার বাড়িতে। বিশেষ কিছু নিতে পারিনি। গাছে একটা বড় লাউ ছিল, সেটা নিয়ে গেছে। নিয়েছে দুইটা পাতিহাঁস। ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে দিয়েছিল হাঁস দুইটা। ডিম পাড়ত। দিন সাতেক আগে থেকে ডিম দিতে শুরু করেছিল। রাতে নেয়নি; নিয়েছে এখান থেকে তার যাবার আগে আগে, সন্ধ্যারাতে। কি সর্বনাশটা হয়ে গেল তার!

বিয়ে
প্রতীকী ছবি

কতবার বলেছে একটা বিয়ের করার কথা। তার ঘরে একটা বউ থাকলে এমন কিছু হতে পারত কাল? সেতো সারাক্ষণ বাড়িতেই থাকত। আর তার বয়সের মানুষ কি বিয়ে করে না। তার দাদার দাদা সাতটা বিয়ে করেছিল। তার দাদা করেছিল চারটা। সে করেছে মাত্র দুইটা। মানুষের মুখে শোনা যায় তার কথার জন্যই নাকি দুই বউয়েই ছেড়ে গিয়েছিল। তারপর সে বিয়ের চেষ্টা যদিও কম করেনি কিন্তু ছেলেমেয়ে আর পরিবারের অন্যদের চাপে সেটা করতে পারিনি। তবুও বেশ কয়েকবার বউ দেখেও এসেছে। একবার বড় ঘরের এক মেয়েও দেখে এসেছিল। বয়স তার মতোনই, জামাই ছেড়ে চলে আসছিল। এখন বাপের বাড়িতেই থাকে। তাকে তার বেশ পছন্দ হয়েছিল কিন্তু নেহাত গরিব বলে তার কপালে সে আর জুটেনি। অনেক দিন সে বাড়িতে যাওয়া–আসাও করেছিল সে। এমনভাবে বলে যেন গতকালের চুরিটা তার বউ না থাকার জন্যই হয়েছে। হোসেন মিয়ার মুখে কথার খই ফুটতে ফুটতে আজও সন্ধ্যা হয়। এর মধ্যে শুধু খাওয়ার সময় তার মুখ বন্ধ থাকে। খাওয়ার সময় সে একেবারে অন্য এক মানুষ। মুরুব্বিদের কথা, খাবার সময় কথা বলতে নেই। সে সেটা মানে খুব। সেই একটা সময়েই তার কথার স্রোত থেকে সবাই রক্ষা পায়। আর এ বাড়িতে কাউকে না খাইয়ে বিদায় দেওয়ার রীতিও একেবারে নেই বললেই চলে। সে খাবারের গুণ হোসেন মিয়াও আজীবন করে এসেছে।

সেদিনের পর অনেক দিন তার দেখা পাওয়া যায়নি। এমনকি সেবার ঈদেও আসেনি। দুই ঈদ গেল হোসেন মিয়া নেই। আয়নাল হাজির মা বেশ অবাকেই হলেন, এমন কখনো হয় না। যে মানুষটা প্রতিবার ঈদে সালাম করে যায়, খেয়ে যায় দুমুঠো ভাত। সে এবার আসেনি, একটা শূন্যতা থেকেই যায় তার জন্য। তিনি ছেলেদের খোঁজ নিতেও বললেন যে, ‘দেখিস তো কী হয়েছে ওর।’ এক শ্রাবণের দুপুরে সে হাজির বাড়ির। সঙ্গে আরেক আধা বয়সী মহিলা। চুলে পাক ধরেছে। এসে বললো, ‘দাদু নাতবউ দেইখ্যা যান, আইজ আর বইতাম না। আপনাকে দেইখা চইলা যাইয়াম।’ তারপর শুরু হয় তার কথা। কীভাবে বিয়ে করল, কেন আসতে পারল না, এবারের ঈদে আরও নানা কথা। বউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে সে কানে হাত দিয়ে মাথাটা মুখের কাছাকাছি এনে শোনার চেষ্টা করে। মুখে কৃত্রিম হাসি দেয়। হোসেন মিয়া অবশ্য পরিচয় করানোর সময়েই বলছিল, ‘দাদু ওর সমস্যা একটাই, কানে কম হুনে একটু।’ দাদি বলে, ‘ ভালোই হইলো, এইবার তাইলে আর যাইব না বউ তর ক্যাটকাটানি হুইন্যা’। হোসেন মিয়া আবার গল্প শুরু করে।      
লেখক: সৌরভ আহমেদ , নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। মেইল অ্যাড্রেস [email protected]