‘কথার ভাঁজে প্রাণে আসুক নতুন পল্লব’

চিঠি এসেছে গো চিঠি! এই ডাক এখন শুধুই স্মৃতি। হৃদয়ের কতশত আবেগ, ভালোবাসা ও স্মৃতিময় কথাগুলো জমা হতো একটি খামে মোড়ানো পত্রে। অন্তরের খুব গভীরের কথাগুলো সযত্নে সাজিয়ে নেওয়া যেত চিঠিতে।

যার শুরু হতো প্রিয়, সুচরণেষু অথবা কল্যাণীয়েষু আর শেষ হতো ইতি দিয়ে। শুধু প্রেম, ভালোবাসা আর বিরহের গল্প নয়। একটা সময় সব ধরনের যোগাযোগের মাধ্যমই ছিল চিঠি। বেকারত্বের বোঝা বয়ে বেড়ানো কোনো এক বেকারের চাকরির খবর, দূর প্রবাসে থাকা ছেলের তার মায়ের কাছে লেখা চিঠি, শহরে লেখাপড়া করা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের তার বাবার কাছে টাকা চেয়ে লেখা চিঠি আবার কখনো–বা মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে আসা চিঠি পরিবারে বয়ে আনত স্থবিরতা। আসলে চিঠিতে যত সুন্দর ভাষায় মনের অনুভূতি গুছিয়ে প্রকাশ করা যায়, মুখে ততটা বলা হয়ে ওঠে না। প্রেয়সীর কাছে রঙিন খামে সুগন্ধি মেখে চিঠি লিখত প্রেমিক, এমন কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। এসব কোনো বানোয়াট বা কাল্পনিক গল্প নয়, একেবারেই সত্যি ঘটনা। প্রেয়সী, স্বজন অথবা বন্ধু অপেক্ষায় থাকত তাদের কাছের মানুষের একটি চিঠির জন্য। কখনো–বা হাসি–আনন্দের অনুভূতি মাখানো সুসংবাদ আবার কখনো–বা হৃদয়ে মোচড় দিয়ে ওঠা দুঃসংবাদ। কত কিছুই না মোড়ানো থাকত একটি খামে।

মানুষের হৃদয়ের, আবেগের ও ভালোবাসার সেসব কথা আদান–প্রদানের একটিমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি।

চিঠিরও রয়েছে নানা ইতিহাস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিগত চিঠিগুলোও সাহিত্যচর্চায় স্থান পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গন থেকে স্বজনের কাছে লেখা চিঠি এখন ইতিহাসের অংশ।

কালের আবর্তে চিঠি শব্দটাই যেন হারিয়ে গেছে। দাপ্তরিক কোনো কাজের নথি ছাড়া এখন আর চিঠির আদান–প্রদান দেখা যায় না। তার পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ও ই–মেইল।

এখন আর সাইকেলের বেল বাজিয়ে আসা ডাকপিয়নদের দেখা মেলে না। চিঠি পৌঁছে দিতে যাঁদের ত্যাগ ও জীবনসংগ্রাম নিয়ে ‘রানার’ কবিতা লিখেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। এখন আর কোনো বাড়ির গেটে দেখা মেলে না চিঠির বাক্সের। ডাকঘর এখনো আছে, কেবল ডাকবাক্সগুলোই খালি পড়ে আছে। বহু আগে ইংরেজ কথাকার সমারসেট মমের উক্তিই যেন বর্তমানের বাস্তবতায় সত্যি হয়ে উঠল। চিঠি লেখা আসলেই এক হারিয়ে যাওয়া শিল্প। প্রতিবছর ১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস পালিত হয়।

বর্তমান প্রজন্মের কাছে চিঠির প্রচলন যখন বিলীন, এমন সময়ে উত্তরের বাতিঘর খ্যাত রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পমনা শিক্ষার্থীদের সংগঠন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিল্প ও সাহিত্য সংসদের আয়োজনে দিনব্যাপী পালিত হলো ব্যতিক্রমী এক উৎসব ‘চিঠি উৎসব’। ‘কথার ভাঁজে প্রাণে আসুক নতুন পল্লব’ স্লোগান হৃদয়ে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় সড়কে দিনব্যাপী তাঁরা এ আয়োজন করেন। আয়োজনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি করেছিল উৎসবের আমেজ। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ উৎসবে অংশ নেন। দিনব্যাপী এ আয়োজনে ছিল চিঠি লেখার কাগজ ও খামের ব্যবস্থা। একই সঙ্গে ছিল ভ্রাম্যমাণ ডাকবাক্স ও দেয়ালিকা। উৎসবে আসা শিক্ষার্থীরা যাঁর যাঁর ইচ্ছেমতো বন্ধু, স্বজন অথবা প্রিয়জনকে উদ্দেশ করে স্মৃতিময় ঘটনা বা মনের কথাগুলো চিঠিতে লিখে খামে ভরে ডাকবাক্সে ফেলছেন। সেখান থেকে আয়োজকেরা চিঠিগুলো ভ্রাম্যমাণ দেয়ালিকায় ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। আগ্রহী পাঠকেরা সেগুলোয় চোখ বোলাচ্ছেন। ব্যতিক্রমী এই আয়োজন দেখতে দর্শনার্থীদের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। শিক্ষার্থীদের কাছে পুরো আয়োজনটাই যেন ছিল নস্টালজিক একটা ব্যাপার!

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেছেন, ‘চিঠিকে আমরা সাহিত্যের অংশ মনে করি। আমরা যদি আবার চিঠির সূচনা করি, তাহলে আমাদের প্রজন্মের সামনে আরেকটি দিক উন্মোচিত হবে।’ এই চিঠি উৎসবের আয়োজকদের ভাষ্যেও তেমনটিই শোনা গেছে।

বসন্তের আগমনে ফাল্গুনের প্রথম দিনে এই আয়োজনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় সড়ক তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে নানা বয়সী মানুষের পদচারণে ছিল মুখর।

  • লেখক: আরবাজ হোসেন (রুমান), মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

**নাগরিক সংবাদ-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]