টিএসসি: আমরা কি ঠিক করছি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)।
ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবীর বিবর্তনে সবচেয়ে শক্তিশালী অলিখিত ইতিহাস হচ্ছে স্থাপত্য। অনেক ক্ষেত্রে আমরা বইয়ের পাতায় যে ইতিহাস–ঐতিহ্যের কথা পাই, তা হয়তো হারিয়েও যেতে পারে। কিন্তু ইট–চুন–সুরকিতে লেখা ইতিহাস সহজে হারায় না। সভ্যতার প্রয়োজনে তারা কথা বলে ওঠে। এর সত্যতা জানতে বহুদূর যাওয়ার দরকার নেই, পাহাড়পুর কিংবা ময়নামতিতেই আমরা খুঁজে পাব। পানাম নগরীর ইতিহাস বই খুলে না পড়লেও ওই মৃত নগরীর সরু রাস্তা ধরে হেঁটে গেলেই যে কেউ শুনতে পাবে এই নগরীর গল্প।

স্বাধীনতার ৪৯ বছর বয়স, একটা দেশের জন্য হয়তো খুব বেশি না। এই মাটি, এই দেশ কী, বুঝতে হলে এর ক্রমবিকাশ, ঐতিহ্যের ধারা, স্বকীয়তার টানাপোড়েন, জাতি হিসেবে চারিত্রিক গুণাবলি আর রুচি বুঝতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু এগিয়েছি, তা বুঝতে হলেও এই অলিখিত ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে হয়। তাই তো জাতির ৪৯ বছরে আমরা বলতে পারি, গত এক বা দুই দশকে আমাদের স্থপতিরা, বাংলাদেশি স্থপতিরা দেশের নিজস্ব ধারার স্থাপনা পৃথিবীর বুকে তুলে ধরছেন। আমরা গর্ব করে বলতে পারি, এই স্থাপনা বাংলাদেশি স্থাপনা।

তবে এই প্রক্রিয়াটা কিন্তু হঠাৎ শুরু হয়েছে তা না, এর ধারা শুরু হয়েছিল যখন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৪ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউটের নকশা করেন। পরে অনেক বিদেশি স্থপতি এসেছেন, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম কালজয়ী স্থপতি লুই আই কানকে নিয়ে এসেছেন জাতীয় সংসদ ভবনের নকশার জন্য। ষাটের দশকে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বাংলাদেশে তৈরি হয়, যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, বুয়েট স্থাপত্য বিভাগ ভবন, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ নানা কালজয়ী স্থাপনা, যেগুলো এখনো আন্তর্জাতিকভাবে পড়াশোনা ও গবেষণার বিষয়।

এই লেখার উদেশ্য মূলত এই যে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের ভবন ভাঙা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত কতটা আত্মঘাতী, তা তুলে ধরতেই এ লেখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের স্থাপত্যশৈলী নিয়ে আমি পরে বলছি। তার আগে এই স্থাপনাকে বোঝা দরকার এর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও জাতীয় চেতনার মাপকাঠিতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পূর্ব দিকে রয়েছে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান, যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বাংলার প্রাণের বইমেলার অনবদ্য ঠিকানা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমিতে এর গুরুত্ব আমরা সবাই জানি। দক্ষিণে বাংলা একাডেমি, আরও দক্ষিণে মোগল স্থাপনা, ঢাকার প্রবেশদ্বারখ্যাত মীর জুমলার তোরণ বা রমনা গেট, যার উল্টো পাশে তিন নেতার মাজার। কিছুদূর গেলেই দোয়েল চত্বর, যাকে ঘিরে আছে শিশু একাডেমি আর কার্জন হল। কার্জন হল থেকে পশ্চিমে শহীদ মিনার। আর ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের উত্তরে আছে শাহবাগ, যা বলা চলে নাগরিকের কথা বলার একমাত্র মঞ্চ। এবার চোখটা বন্ধ করে ভাবেন, এ সবকিছুর নিউক্লিয়াস হলো এই ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্র। নাগরিক মননে এই স্থাপনা যে অবয়ব তৈরি করে রেখেছে, তা প্রাচীন। এই সম্পর্ক আত্মার, যা স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও সবার কাছে একরকম।

এই ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো যে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করেছে, তা এই রাষ্ট্রের অলিখিত ইতিহাস, আমরা কাল না থাকলেও এই স্থাপনাগুলোই আমাদের ঐতিহ্যের কথা বলবে। এবার আসি এই স্থাপনার নির্মাণশৈলীতে, যার মূল ভবন নকশা করেন গ্রিক স্থপতি কন্সটেন্টিনোস এপোস্তলো ডক্সিয়াডিস ১৯৬২ সালে। একটি অভ্যন্তরীণ উঠানকে কেন্দ্র করে তৈরি এই নকশা। ঢুকতেই যে ভবন তাতে ‘বাটারফ্লাই ক্যানপি’ দেখতে পাওয়া যায়, যা আসলে ছাদের কাঠামোকে অনেকটা প্রজাপতির পাখার মতো করে তুলেছে। এর ভেতরে গেলে পাওয়া যাবে ছাত্রসংগঠনগুলোর মূল কক্ষ, পাঠাগার, অডিটরিয়াম, খাবারের জায়গা, খেলার জন্য নির্ধারিত কক্ষ, সুইমিংপুলসহ আরও কিছু সুবিধাসংবলিত কক্ষ। অডিটরিয়াম লম্বায় প্রায় ১৭০ ফিট আর চওড়ায় ৮৫ ফিট, যার ছাদ অর্ধবৃত্তাকার বা প্যারাবলিক ভল্ট আকারে তৈরি। এই ছাদের নির্মাণশৈলী এখনো অনুকরণীয়। ভবনে জালির ব্যবহার যেমন আলো–বাতাসকে ঢুকতে দিচ্ছে তেমনি অভ্যন্তরীণ পরিসরকে আড়ালও দিচ্ছে। চত্বরের সবগুলো ভবন স্টিলের কলামে তৈরি করিডর দিয়ে সংযুক্ত, যা করিডরের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছে। সর্বোপরি বাইরের সঙ্গে দৃশ্যত যে যোগাযোগ, তা অটুট রেখেছে। কেন্দ্রীয় উঠানের দক্ষিণ–পূর্ব কোনায় আছে দেশের একমাত্র গ্রিক স্থাপনা, চৌকো একটি সমাধি, নির্মাণশৈলীতে গ্রিক স্থাপত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। আর আছে দুটো শিবমন্দির। সবগুলো স্থাপনা যে সাম্য আর সামঞ্জস্যে একে অপরকে ধারণ করেছে, তা এখনো আমাদের কাছে একটা ধাঁধার মতো। কেউ যদি একবার ভেতরে ঢোকে যেন নতুন আরেকটা শহর খুঁজে পাবে।

আমরা উন্নয়নের বিরোধী না, আমরা অবশ্যই চাই দেশের সবচেয়ে পুরোনো আর ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর বৃদ্ধি পাক। কিন্তু ইতিহাস বিসর্জন দিয়ে নয়।

আমরা কি এতই নির্বোধ হয়ে গেছি যে ইতিহাস, শহরের গল্প, নাগরিক মনন বিসর্জন দিয়ে এমন একটা স্থাপনা ভেঙে ফেলব। এমনিতেই মেট্রোরেলের কাঠামো যখন ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সামনের রাজু ভাস্কর্যের ওপর এসে পড়ল, আমরা হতবাক আর বিস্মিত হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, কয়েকজন জ্ঞানী-গুণী মানুষ একসঙ্গে বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রকে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর বৃদ্ধির একটা সময় উপযোগী সমাধান আমরা করতে পারি। শিক্ষাবিদ, স্থপতি, কবি, নগর পরিকল্পনাবিদেরা চাইলেই কীভাবে আর কোথায় প্রস্তাবিত কাঠামোগুলো করলে ভালো হয়, এমন একটা গুণগত সিদ্ধান্তে আসা কোনো কঠিন কিছু না। অটুট ইতিহাস আর শহরের গল্পেরা যাতে হারিয়ে না যায়, এমন একটা ভয়হীন ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকলাম।


*লেখক: অমিত ইমতিয়াজ, স্থপতি ও সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়