লোকসংস্কৃতি ও এসডিজি: যুগপৎ হতে পারে এক নতুন সম্ভাবনার যাত্রা

লোকসংস্কৃতিকে বিবেচনা করতে হবে সাংস্কৃতিক অবকাঠামো হিসেবে। অতীত জীবনের প্রতিধ্বনি হিসেবে লোকসংস্কৃতিচর্চাকে অনেক সময় ভুলভাবে ব‍্যাখ‍্যা করে হয়ে থাকেফাইল ছবি: প্রথম আলো

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সময়ে লোকসংস্কৃতি-গবেষকদের প্রতি প্রায়ই সংশয়ের প্রশ্ন ছোড়া হয়—ভবিষ্যতের দুনিয়ায় লোকজ সংস্কৃতির আদৌ কোনো ব্যবহারিক গুরুত্ব আছে কি? অথচ বিশ্বে যখন পরিবেশগত বিপর্যয়, সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্য বাড়ছে, তখন প্রশ্ন ওঠা উচিত—যদি আমরা আমাদের ঐতিহ্যে নিহিত জীবন্ত ও সমাজ-প্রজন্মের জ্ঞানকে অবহেলা করি, তবে আমরা কী হারিয়ে ফেলব?

বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলার প্রচেষ্টা সাধারণত বৈজ্ঞানিক তথ্য ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ওপর নির্ভরশীল। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) আরও গভীর এক সত্যের দিক নির্দেশ করে। সেটা হলো, টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে শুধু নীতিগত সংস্কার বা প্রযুক্তিগত সমাধান যথেষ্ট নয়। এর জন্য দরকার মূল্যবোধ, আচরণ এবং পরিচয়ের রূপবদল। অর্থাৎ আমাদের পরস্পরের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার ধরনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে। ঠিক এখানেই লোকসংস্কৃতির স্থায়ী প্রাসঙ্গিকতা উঠে আসে। অতীতের নিছক স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নয়; বরং আগামীর পথরেখা নির্ধারণে সাংস্কৃতিক দিকনির্দেশক হিসেবে লোকসংস্কৃতি অপরিহার্য।

জীবন্ত কাঠামো হিসেবে লোকসংস্কৃতি

অতীত জীবনের প্রতিধ্বনি হিসেবে লোকসংস্কৃতিচর্চাকে অনেক সময় ভুলভাবে ব‍্যাখ‍্যা করে হয়ে থাকে। বাস্তবে লোকসংস্কৃতি একটি জীবন্ত সামাজিক জ্ঞানব্যবস্থা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের মানে খোঁজা, দুর্যোগ ও দুর্দিনে টিকে থাকা এবং পরিবেশ ও সমাজের ভারসাম্য রক্ষার কৌশল ধরে রেখেছে।

গল্পকথা, আচার-অনুষ্ঠান, গান, ঋতুভিত্তিক প্রথা এবং লোকশিল্পের মাধ্যমে লোকসংস্কৃতি বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার, পরিবেশ সচেতনতা, সামাজিক সহমর্মিতা, নৈতিক বোধ এবং পারস্পরিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতা প্রজন্মান্তরে সংরক্ষণ ও চর্চা করে চলেছে।

এই কারণেই লোকসংস্কৃতিকে বিবেচনা করতে হবে সাংস্কৃতিক অবকাঠামো হিসেবে। এটি একটি গভীরভাবে প্রোথিত জ্ঞানব্যবস্থা, যা সমাজ কীভাবে পরিবর্তনের প্রতি সাড়া দেয়, সেই ধরন গড়ে তোলে। বিজ্ঞান বা উদ্ভাবনের বিরোধিতা নয়, বরং লোকসংস্কৃতিচর্চা এমন একটি সাংস্কৃতিক কাঠামো, যার ভেতরেই বিজ্ঞান বা উদ্ভাবনের অগ্রগতি গড়ে উঠতে পারে এবং সমাজে অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।

কার্যকর ফোকলোর চর্চা: এসডিজিতে লোকসংস্কৃতি

লোকসংস্কৃতি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদিও প্রায়ই তা উপেক্ষিত থাকে। বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়—

এসডিজি ২: ক্ষুধামুক্তি এবং ঐতিহ্যভিত্তিক খাদ্য ও কৃষির পুনরুজ্জীবন

ক্ষুধা মুক্তির জন্য আদিবাসী কিংবা দেশজ বীজ, স্থানীয় কৃষি জ্ঞান ও ঐতিহ্যবাহী খাদ্য সংস্কৃতি রক্ষা ও ব্যবহারে জোর দেওয়া জরুরি। এতে শুধু পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না, বরং কৃষির বৈচিত্র্য বাড়ে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা মেলে।

● এসডিজি ১৩: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা

পরিবেশসংক্রান্ত ও জলবায়ু মানানসই জ্ঞান, সৃজনশীল উদ্যোগ ও উদ্ভাবনীর পাশাপাশি মৌখিক ঐতিহ্যে সংরক্ষিত থাকে পরিবেশভিত্তিক জ্ঞান—গল্প, ঋতুচিহ্ন ও সামষ্টিক চর্চা, যা স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক ও অভিযোজন ক্ষমতার পরিচয় বহন করে।

● এসডিজি ১১: টেকসই নগর ও সম্প্রদায়

লোকাচার, উৎসব এবং স্থানীয় রীতিনীতিগুলো স্থানভিত্তিক পরিচয় ও সামষ্টিক সম্পৃক্ততা গড়ে তোলে, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহনশীল নগর গঠনের অপরিহার্য উপাদান।

● এসডিজি ৮: মর্যাদাপূর্ণ কাজ ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

ঐতিহ্যনির্ভর শিল্প খাত জীবিকায় নতুন অর্থ জোগায়—এগুলো স্থানীয় শিল্পীদের ক্ষমতায়ন করে, সাংস্কৃতিক মর্যাদা বজায় রাখে এবং গ্রামীণ, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করে।

● এসডিজি ১০: বৈষম্য হ্রাস

লোকসংস্কৃতি প্রান্তিক কণ্ঠকে স্বীকৃতি দেয়—বহুস্তরীয় সাংস্কৃতিক প্রকাশকে সমর্থন করার মধ্য দিয়ে এটি বঞ্চনা মোকাবিলা ও সমতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।

● এসডিজি ৪: মানসম্মত শিক্ষা

লোকসংস্কৃতিচর্চা একটি বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা উপস্থাপন করে—মৌখিক গল্প বলার মাধ্যমে সহমর্মিতা, নৈতিক বিবেচনা, বিশ্লেষণী চিন্তা ও আন্তঃপ্রজন্ম শেখার সুযোগ তৈরি হয়, যা প্রথাগত শিক্ষায় অনেক সময় উপেক্ষিত থাকে।

● এসডিজি ৩: সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ

সাংস্কৃতিক চর্চা মানসিক ও আবেগগত স্থিতিশীলতা বাড়ায়—আচার-অনুষ্ঠান, গান ও গল্পকথা বিশেষ করে বাস্তুচ্যুতি ও ট্রমার প্রেক্ষাপটে মানসিক প্রশান্তি, সংযোগ এবং নিরাময়ের সহায়ক হয়ে ওঠে।

লোকসংস্কৃতি, উন্নয়ন ও টেকসই অধ্যয়ন (এফডিএসএস) একটি নতুন আন্তঃবিষয়ক ক্ষেত্র হতে পারে। বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জের আরও সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তায় একটি নতুন ক্ষেত্র এখন উদীয়মান। এফডিএসএস এই আন্তঃবিষয়ক কাঠামো লোকসংস্কৃতিকে একটি গতিশীল, সমাজভিত্তিক সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ পুনরুজ্জীবন এবং সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এফডিএসএস গবেষক, শিক্ষাবিদ, নগর পরিকল্পনাকারী, লোকশিল্পী এবং নীতি প্রণেতাদের একত্রিত করে, যাদের লক্ষ্য হলো উন্নয়ন চিন্তাধারায় সাংস্কৃতিক বুদ্ধিমত্তাকে সংযুক্ত করা।

প্রতিবাদের লোকশিল্পচর্চা, গ্রাফিতি, আলপনা, জীবনকৌশলের গল্প

এফডিএসএসের কেন্দ্রে রয়েছে এক গভীর বিশ্বাস। হস্তশিল্প জ্ঞান, সেলাই, সংগীত, বুনন বা মিথ—শুধু ঐতিহ্য নয়। এটি পুনর্জীবনের এক অমূল্য উৎস।

লোকশিল্পচর্চা পরিবেশ সচেতনতা, ধৈর্য এবং যত্ন বৃদ্ধি করে। জৈববিষয়ক ও স্থানীয় উপকরণ দিয়ে কাজ করা শিল্প উৎপাদনের শোষণমূলক ভাবধারাকে প্রশ্ন করে এবং আমাদের প্রকৃতির ছন্দের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করে। এই কাজগুলো কেবল ব্যবহারিক নয়, বরং প্রতীকী—এগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে টেকসই শুরু হয় আমরা কীভাবে উপকরণ, শ্রম এবং স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করি তার মাধ্যমে।

তেমনি লোক গল্পকথা শুধু একটি মৌখিক ঐতিহ্য নয়, এটি সামাজিক পথনির্দেশনার একটি মাধ্যম। গল্পগুলো পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করে, স্মৃতিকে সংরক্ষণ করে এবং সম্ভাবনার চিত্রায়ণ করে। বিভ্রান্তির মুহূর্তে, এগুলো সমাজকে পুনরায় পরিচয় ও পথ খুঁজে নিতে সহায়তা করে।

কর্মপ্রেরণার আহ্বান: এখন লোকতত্ত্ববিদদের সময়

লোকতত্ত্ববিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সমাজের গল্পকারদের উদ্দেশে বলা যায়, আপনারা শুধু অলংকরণ নয়, আপনাদের কাজ মৌলিক। যেসব জ্ঞানব্যবস্থা আপনি সংরক্ষণ ও নবায়ন করেন, তা ন্যায়পরায়ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য অত্যাবশ্যক।

বিজ্ঞানীরা গ্রহের প্রক্রিয়াগুলো পর্যবেক্ষণ করে, প্রকৌশলীরা নবায়নযোগ্য অবকাঠামো গড়ে তোলে, আর লোকতত্ত্ববিদেরা নিশ্চিত করেন যে এসব উদ্যোগ অর্থপূর্ণ, ভাষায় গ্রহণযোগ্য এবং স্থানীয় পরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সাংস্কৃতিক বোধগম্য কোনো বিলাসিতা নয়, এটি পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য।

এই যুগে শুধু উদ্ভাবন নয়—আমাদের প্রয়োজন অন্তর্দৃষ্টি। শুধু তথ্য নয়, প্রয়োজন পথপ্রদর্শন। শুধু কৌশল নয়, প্রয়োজন ভাগ করে নেওয়া গল্প।

বিশ্ব এখন হয়তো লোকসংস্কৃতি ও এসডিজির যুগপৎ নতুন সম্ভাবনার যাত্রা শোনার জন্য প্রস্তুত।

* আব্দুল্লাহ আল মামুন: শিক্ষক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়