প্রতিভা বিকাশে সংবাদপত্র পাঠ জরুরি
আজকাল শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ কম দেখা যায়। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল লাভের জন্য যতটুকু পড়া দরকার, তার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে ফেলছেন তাঁরা। কেননা, আমাদের সমাজে পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের ভিত্তিতেই একজন শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা হয়। মনে করা হয়, যাঁর যত ভালো রেজাল্ট, তিনি তত মেধাবী। পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পাওয়া শিক্ষার্থীটিও যে মেধাবী হতে পারেন, তা মানতে নারাজ অনেকে। পরীক্ষার ফলাফলই যেহেতু বলে দেয় কে ভালো ছাত্র বা ছাত্রী, সেহেতু বুঝে হোক কিংবা না বুঝে, মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখে দিয়ে একটি ভালো রেজাল্ট করতে পারলেই মুক্তি পান তাঁরা! পরীক্ষার সিলেবাসের বাইরেও যে অনেক কিছু শেখার আছে, তা অনেকের চিন্তায়ও আসে না।
একাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, সমসাময়িক বিশ্ব, সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ইস্যু শিক্ষার্থীদের জানতে হবে। তার জন্য নিয়মিত সংবাদপত্র ও বই পড়ার বিকল্প নেই। একজন শিক্ষার্থী যদি নিয়মিত পত্রিকায় চোখ বুলান, তাহলে তিনি একজন সচেতন নাগরিক হয়ে উঠবেন। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত বাসায় প্রতিদিন কমপক্ষে একটি হলেও পত্রিকা রাখা। বাসায় পত্রিকা রাখা হলে পরিবারের সদস্যরা একবার হলেও এটি হাতে নেন। কেউ পত্রিকায় ছাপানো রঙিন ছবি দেখে আনন্দ লাভ করে—বিশেষ করে ছোট সোনামণিরা। হেডলাইনগুলোতে একবার চোখ বুলান কেউ কেউ। আবার অনেকে নতুন নতুন শব্দ সংগ্রহ করে নিজের শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন। দেশ ও দেশের বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে সবার মোটামুটি একটা আইডিয়া চলে আসে প্রতিদিনকার সংবাদপত্রে চোখ রাখলে। অনেকের তো চায়ের চুমুকে পত্রিকা না হলে চলেই না! মোদ্দাকথা, ছোট থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা গেলে সৃজনশীল হয় উঠবেন তাঁরা।
নিয়মিত পত্রিকা পড়লে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়ও ভালো করা যায়। একটি পত্রিকায় স্থানীয়, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, খেলাধুলা, বিনোদনসহ বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। রয়েছে সম্পাদকীয় পাতা। দেশ ও দেশের বাইরের নানান খবর আমরা পত্রিকার মাধ্যমেই জানতে পারি। প্রযুক্তির এ যুগে পত্রিকা কেবল ছাপার কাগজে সীমাবদ্ধ নেই। এখন আমরা চাইলে অনলাইনেও আমাদের পছন্দের পত্রিকাটি পড়ে নিতে পারি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে মানুষের কাছে মুহূর্তের মধ্যেই খবরাখবর পৌঁছে গেলেও সংবাদপত্রের আবেদন কমেনি; বরং দিন দিন পত্রিকাগুলোর কাজের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একজন তরুণ পাঠক পত্রিকা পড়ার মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারছেন। আবার অনেক তরুণ আছেন, যাঁরা পত্রিকা কেন পড়তে হবে, কীভাবে পড়তে হবে, এ সম্পর্কে অজ্ঞ। এটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নিজ এলাকায় থেকে পড়াশোনা করার সুবাদে অভিজ্ঞতাটি আমার হয়েছে। আমাদের এলাকায় এখনো কোনো পত্রিকা পাওয়া যায় না উপজেলা শহরে না গেলে। হাতের কাছে পত্রিকা না পাওয়া কিংবা পড়ার অভ্যাস না গড়ে ওঠায় সংবাদপত্র পড়া থেকে বিমুখ থাকছেন অনেকে। ফলে এখনকার শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহে ভাটা পড়ছে। নিজেদের সুপ্ত প্রতিভা নিদ্রিতই রয়ে যাচ্ছে। অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছেন তাঁরা। অনলাইনে পত্রিকা পড়া গেলেও অভ্যাস না থাকায় তা-ও হয়ে ওঠে না অনেকের।
আবার অনেকে মা-বাবা, শিক্ষক বা বড় কোনো ভাই-বোনের অনুপ্রেরণায় পত্রিকা পড়েন। পত্রিকা পড়লে নিজের লেখকসত্তা সহজে জাগিয়ে তোলা যায়। আমরা যাঁরা পড়ালেখা করি সবাই পড়ি ও লিখি। ছোটবেলা থেকে আমরা লিখে আসছি। স্কুল কিংবা কলেজ থেকে দেওয়া বাড়ির কাজ আমরা লিখে নিয়ে স্যারদের দেখাই। এ ছাড়া আমরা নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় ডায়রিতে লিখে রাখি। অনেকে সময় পেলে খাতা-কলম নিয়ে বসেন। সবাই মোটামুটি লিখি, কিন্তু সবার লেখা কী একটি সুন্দর লেখনী হয়ে ওঠে! আপনি যদি নিয়মিত পত্রিকায় ছাপানো কলামগুলো পড়েন, আপনার লেখাতেও সৌন্দর্য চলে আসবে। বিভিন্ন লেখকের লেখা পড়লে বুঝতে পারবেন তাঁরা তাঁদের লেখায় কোন শব্দগুলো ব্যবহার করছেন। তাঁরা পাঠককে যে ম্যাসেজটি দিতে চান, সেটি কী করে প্রাণবন্ত করে উপস্থাপন করছেন। যাঁরা লেখক হতে চান, তাঁদের জন্য তো বেশি বেশি পড়ার বিকল্প নেই।
আশার কথা হলো, তরুণেরা পত্রিকা পড়েন। পত্রিকায় লেখালেখিও করেন তাঁরা। সমাজের নানান অসংগতি তাঁদের কলামে ওঠে আসে। তাঁদের সৃজনশীল লেখনী পাঠকহৃদয়ে প্রশান্তি বয়ে আনে। কোথাও রাস্তাঘাট কিংবা কালভার্ট-ব্রিজ ভাঙা দেখলে তা নিয়ে চিঠিপত্র পত্রিকা অফিসে পাঠান তরুণ লেখকেরা। নিজ এলাকার মানুষের দাবিদাওয়া নিয়েও লেখেন তাঁরা। একজন তরুণ যখন তাঁর নিজের লেখাটি পত্রিকার ছাপা কাগজে বা অনলাইনে দেখতে পান, তখন লেখালেখির প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। তিনি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। বই পড়া ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা তাঁর মধ্যে প্রবল হয়।
পরিশেষে বলতে চাই, একজন শিক্ষার্থীকে হতে হবে সৃষ্টিশীল ও বিচক্ষণ। শুধু পরীক্ষা নামক চার দেয়ালে নিজেকে আবদ্ধ করলে চলবে না। তাঁকে তাঁর চারপাশের খবরাখবর রাখতে হবে। কীভাবে এ ঘুণে ধরা সমাজকে পরিবর্তন করা যায়, তা নিয়ে কলম ধরতে হবে তাঁকে। এ জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। বেশি বেশি বই পড়তে হবে। সংবাদপত্রে চোখ বুলাতে হবে।
*লেখক: মারুফ হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া