চরিত্রায়নের জাদুকর তিনি

হুমায়ূন আহমেদ
ছবি: প্রথম আলো

তখন মুঠোফোন আমাদের হাতে আসেনি। গ্রামে থাকতাম সে সময়ে এবং একটি পত্রিকা হাতে পেতেও অনেক সময় লেগে যেত। আমাদের গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটি বাজারে দু–একটি পত্রিকা আসত। বিকেলে বাজারে গিয়ে সিরিয়াল দিয়ে সেই পত্রিকা পড়তে হতো। পত্রিকা পড়ার নেশা ছিল তীব্র।  তাই যত কষ্টই হোক পত্রিকা পড়ে বাড়িতে ফিরতাম। প্রতিদিনের মতোই বিকেলে বাজারে গেলাম পত্রিকা পড়তে। পত্রিকার শিরোনাম দেখে অবাক হয়ে গেলাম।

বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধের দাবিতে ঢাকার রাজপথে হাজারো মানুষের স্লোগান। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন স্লোগান খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু নাটকের একটি চরিত্রের শেষ দৃশ্যে ফাঁসি হতে পারে—এমন সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে এবং ফাঁসি যেন না হয়, সেই দাবি জানাচ্ছে। এমন নজির দেশে আর কখনো হয়নি—এমনকি বিশ্বেও না। একটি চরিত্রকে নাট্যকার কীভাবে রূপায়ন করলেন যে হাজারো দর্শকের মনে সেটা রেখাপাত করল এবং দর্শক প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজপথে নেমে এল।

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

এমন ঘটনা আর ঘটবে কি না, সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে। একজন লেখকের স্বার্থকতা ঠিক এখানেই। একজন লেখক ও ঔপনাসিক যখন চরিত্রায়নে সর্বোচ্চ মুন্সিয়ানা প্রদর্শনে সক্ষম হন, তখনই শুধু এমনটি ঘটতে পারে। প্রাচীন গ্রিসে সোফোক্লেস যখন কিং ইডিপাস রচনা করলেন, তখন পাঠকের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল নজিরবিহীন।

উইলিয়াম শেকস্‌পিয়ার যখন ম্যাকবেথ, ওথেলো এবং কিং লেয়ারের মতো চরিত্রগুলোকে সর্বোচ্চ মুন্সিয়ানায় রূপায়ন করলেন, তখন তা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করল। জোনাথন সুইফট যখন গালিভারের মতো চরিত্র রূপায়ন করলেন, তখন সারা বিশ্বে হইচই পড়ে গেল। সাহিত্যবোদ্ধাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল সেটা বিশ্লেষণ করতে করতে।

আমাদের দেশেও সাহিত্যবোদ্ধাদের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কোনো কমতি দেখি না। কিন্তু যখনই হুমায়ূন আহমেদের তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তখনই সাহিত্যবোদ্ধাদের একটু ঢিমেতালে বা গড়িমসি ভাব লক্ষ করা যায়। হুমায়ূনের লেখনির সাহিত্যমূল্যকে তাঁরা বিশ্বমানের বলতে নারাজ। সাহিত্য সমালোচনা ছাড়া কোনো সাহিত্যই পূর্ণতা পায় না। সাহিত্য সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে হবে। কিন্তু সেই সমালোচনা হতে হবে গবেষণালব্ধ। ব্যাপক গবেষণা ছাড়া কোনো জনপ্রিয় সাহিত্যকর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা হয়নি বললেই চলে।

কিছু খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন সমালোচনা পাওয়া যায় তাঁর লেখনিকে ঘিরে। আর খণ্ডিত সমালোচনা দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখনির সাহিত্য ও শৈল্পিকমূল্য কতটুকু যাচাই করা সম্ভব, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্বের বেশির ভাগ খ্যাতিমান লেখকেরা মৃত্যুর পর বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। এদিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। তিনি তার জীবদ্দশায় তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন এবং মৃত্যুর পরেও সেটা অব্যাহত আছে।

হুমায়ূন আহমেদ

সমালোচকরা বলতেই পারেন যে হুমায়ূন শুধু তাঁর পাঠক, শ্রোতা আর দর্শকদের বিনোদন দিতেই লিখে গেছেন, লেখার মৌলিকত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে তার মুন্সিয়ানায় ঘাটতি ছিল। কেউ আবার বলতে পারেন, হুমায়ুনের লেখনির সাহিত্য গভীরতা কম। কেউ হয়তো বলবেন তাঁর লেখনিকে ক্লাসিক প্যাটার্নে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আরও অনেক সমালোচনা থাকতে পারেন।

কিন্তু চরিত্র রূপায়নের ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের মুন্সিয়ানা নিয়ে কোনো সমালোচক প্রশ্ন তুলতে পারেননি। আর চরিত্র রূপায়নের মাস্টার ছিলেন বলেই তিনি আজ এত জনপ্রিয়। ম্যাকবেথ, ওথেলো, কিং লেয়ারের মতো সর্বকালের চরিত্র সৃষ্টি করে শেকস্‌পিয়ার বিখ্যাত হয়েছিলেন। জনাথন সুইফটও গালিভারের মতো চরিত্র সৃষ্টি করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে হিমু, মিসির আলী, শুভ্রর মতো চরিত্র রূপায়ন করে হুমায়ূন আহমেদ আজ জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন। বাকের ভাইকে বাঁচাতে দর্শক শ্রেতাদের যে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটেছিল বিশ্বসাহিত্যে বা শিল্পে কমই হয়তো ঘটেছে।

হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করা আমার এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তাঁর লেখনি এবং সৃষ্টি কর্মের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ও প্রায়োগিক প্রভাব ব্যাখ্যা করাই এই প্রবন্ধের লক্ষ। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পটভূমি রচনায় জ্যাক রুশোর লেখা ‘মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত’ লাইনটি অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। একজন লেখকের লেখা একটি দুটি লাইনই সামাজিক কম্পন তৈরি করতে পারে। এমনকি বিশ্ব সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সক্রেটিসের ‘নিজেকে জানো’ উক্তিটি বিশ্ব সভ্যাতার ইমেজকে ধারণ করে। মানুষকে যতই পরাধীন করে রাখা হোক না কেন সে তার সহজাত স্বাধীনতাকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যে স্বাধীনতার কথা বলে গেছেন সক্রেটিস, জ্যাক রুশো, জনাথন সুইফট, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম এবং হুমায়ূন আহমেদ।

‘হিমু’ চরিত্র ও নাসির আলী মামুনের তোলা হুমায়ূন আহমেদের (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)
ছবি অবলম্বনে অলংকরণ: আরাফাত করিম

হুমায়ূন আহমেদ হিমু চরিত্রটিকে সর্বজনীন করতে পেরেছেন। হিমু তাঁর সহজাত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় এবং অবিচল। স্বাধীনচেতা হিমু শুধু একটি নির্দিষ্ট কালের প্রতিনিধি নয়, সে সর্বকালের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। কালজয়ী চরিত্রে নিজেকে দাঁড় করাতে পেরেছে।

হিমু এমন একটি দর্শন ধারণ করেছে যে দর্শন সে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে এবং আর্থসামাজিক আর সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে অনুঘটকের ভূমিকা রেখেছে। সমাজের তরুণ কিশোররা কল্পিত চরিত্র হিমুকে অনুসরণ করেছে। তার ব্যক্তিত্ব, চালচলন, কথাবার্তা, পোশাক অনুকরণ করেছে। হিমু চরিত্রের স্রষ্টা হুমায়ূনের কৃতিত্ব ঠিক এখানে। নগণ্য একটি চরিত্র কীভাবে সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারে হুমায়ূন তা প্রমাণ করে দিলেন।

হুমায়ূন সাধারণ পাঠকের মন পড়তে পারতেন। তার লেখনিতে সহজ–সরল আর প্রাঞ্জল ভাষা ব্যবহার করেছেন কিন্তু ভাষার মাধুর্যতার প্রশ্নে তিনি আপস করেননি। ভাষার মাধুর্যতা একটি লেখাকে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। লেখার পরতে পরতে যে রস পাঠকেরা পেয়ে থাকেন, সেটা এই মাধুর্যতার কারণেই। হুমায়ূন আহমেদের লেখনিতে বৈচিত্র্য বিদ্যমান। কমেডি এবং ট্র্যাজেডির যৌক্তিক সমন্বয় করতে তিনি ছিলেন ওস্তাদ।

তার অনেক নাটকে এবং লেখায় এর প্রমাণ মিলেছে। পাঠক বুঝতে পারছে অমুক চরিত্রটির ট্র্যাজিক পরিণতি হবে (যদিও পাঠক মনে মনে সেটা কামনা করছে না) কিন্তু শেষ অবস্থায় সেই চরিত্রটির কমিক পরিণতি হলো এবং পাঠক তাঁর মনের সুপ্ত স্বস্তি পেয়ে গেল। ট্র্যাজেডি এবং কমিডির এমন সমন্বয় আমরা উইলিয়াম শেকস্‌পিয়ারের নাটকে দেখি।

হুমায়ূন আহমেদ
ছবি: অন্য আলো

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কমিক চরিত্রগুলোকে রোমান্টিক ধাঁচে উপস্থাপনে মাস্টার ছিলেন, যা সচারাচর অন্যান্য লেখকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। অ্যারিস্টটল তাঁর ‘পয়েটিকস’ এ নাটকের তিনটি ইউনিটির কথা বলেছিলেন, যেটা ক্লাসিক নাটকের অপরিহার্য উপাদান ছিল। কিন্তু উইলিয়াম শেকস্‌পিয়ার নাটকের সেই তিনটি ইউনিটকে ভঙ্গ করলেন, কিন্তু নাটকে সৃষ্টি করলেন এক নতুন মাত্রা। হুমায়ূন আহমেদের নাটকে ঠিক এই দিকটা প্রবল ছিল। তিনি নাটকের গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে এসে নাটকের বহুমাত্রিক বিষয়ে প্রাধান্য দিলেন। নাটকের প্লটগুলোকে তিনি ভিন্ন ধাঁচে সাজালেন।

নাটকের কল্পরূপকে জীবন্ত করে তুলতে লাগলেন। প্রতিটি চরিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করলেন, যেন কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং সেই ধারাবাহিকতায় সব ধরনের পাঠক, শ্রোতা ও দর্শককে মজিয়ে রাখা এবং হাসি, কান্না, রসবোধে চাঙা রাখার মতো অসাধ্য কাজটি খুব নিখুঁতভাবে করতে পারতেন হুমায়ূন আহমেদ। বিশ্বের সব ক্লাসিক সাহিত্যের চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা একটি মুখ্য ভূমিকায় থেকেছে। হুমায়ূন আহমেদ চরিত্র নির্মাণে নিরপেক্ষ থেকে ক্লাসিক সাহিত্যের ধারাকে সমুন্নোত রেখেছেন।

হিমু, মিসির আলী, শুভ্রসহ আরও যত চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন, তাদের সব কটির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো নিরপেক্ষতা। উইলিয়াম শেকস্‌পিয়ারের ‘কিং হেনরি ফোর’ নাটকে দেখা যায় রাজার ছেলে তার দুষ্ট বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকে, সময় কাটায়। কিন্তু রাজার ছেলে যখন সিংহাসনে বসল, তখন সে নিরপেক্ষ হয়ে গেল। বন্ধুদের অন্যায় আবদারকে সে পাত্তা দিল না।

হুমায়ূন আহমেদের রচনার আরেকটি অনবদ্য দিক হলো পয়েটিক জাস্টিস। বাস্তবিক ন্যায়বিচার আর কাব্যিক ন্যায়বিচারের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। নাটকীয়তার ধাপে ধাপে পয়েটিক জাস্টিস প্রতিষ্ঠিত হয়। পয়েটিক জাস্টিসের মাধ্যমে পাঠক, দর্শক,  স্রোতাকে মূলত কিছু বার্তা দেয়া হয় এলিগরিক্যাল ধাঁচে। অনেক সমালোচকের মতে হুমায়ূন আহমেদ সংস্কার নিয়ে লেখেননি।

কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ লেখনিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংস্কারের আভাস মিলে। লেখার মধ্যে জীবনের বাস্তবতাকে তুলে আনা এবং পাঠককে নতুন করে স্বপ্ন দেখায় তার লেখনি। পাঠক ও দর্শকদের মনোজগতে বিচরণ করতে পারতেন হুমায়ূন। বিমূর্তকে মূর্ত রূপে এবং প্রাণহীনকে প্রাণ দিয়ে উপস্থাপন করতে পারতেন। পাঠকের অনুভূতির জায়গাগুলো তাঁর ভালো করে জানা ছিল। পাঠককে কল্পজগতে বিচরণ করিয়ে বাস্তবতার স্বাদ গ্রহণ করাতে পারতেন। সব ধর্ম, মত ও পথকে সম্মান করে লিখে গেছেন। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও প্রথাকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনে দক্ষ ছিলেন। লেখায় ভারসাম্যতা, বস্তুনিষ্ঠতা, সেন্স অব হিউমার, দেশপ্রেম ও মানবতাবাদ প্রাধান্য পেয়েছে। দৃশ্যকল্প ফুটিয়ে তুলতে ঝানু ছিলেন।

ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনায় অভিনবত্বের স্বাক্ষর দেখতে পাই। তাঁর ‘শ্যামল ছায়া’ উপন্যাসে হাসান আলীর রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠার গল্পটি পাঠকদের মুগ্ধ করে, নতুন ভাব জগতে নিয়ে যায়। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক লেখক। তার ‘দেয়াল’ উপন্যাসটিতে অসাম্প্রদায়িকতার চিত্র ফুটে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক চেতনা একটি সমাজকে কতটা পিছে ঠেলে দেয়, তা তিনি তুলে ধরেছেন তার বিভিন্ন উপন্যাসে। বাঙালি সম্প্রীতির অনন্য নজির দেখা যায় তাঁর ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর রচনাগুলোতে কাহিনী, সংলাপ, অ্যাকশন এমনভাবে সাজাতেন, যেন যে কেউ পড়লে সে ভাবতে শুরু করত—এটা বুঝি তার নিজের জীবনেরই গল্প। কাহিনী বর্ণনার প্রতিটি পর্বে নাটকীয়তা বিদ্যমান। কাহিনীর নাটকীয়তা পাঠককে শুরুতে সংশয়ী ও নৈরাশ্যবাদী করলেও সমাপ্তিতে পাঠক আশাবাদী হয়েছে এবং হতাশা নয়, আশাতেই যে জীবনের পূর্ণতা তা উপলব্ধি করেছে।

অনেক লেখকের ব্যক্তিগত জীবন তার লেখনির ওপর প্রভাব ফেলে। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর লেখনিতে এর একটু আঁচও লাগেনি। আর এখানেই হুমায়ূনের বিশেষত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে উপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, গীতিকার, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার। তিনি ছিলেন এমনই সৃষ্টিশীল মানুষ যিনি তরুণ আর কিশোরদের বইমুখী করতে পেরেছিলেন, দর্শকদের নাটকমুখী করতে পেরেছিলেন এবং সুস্থ ধারার বাংলা চলচিত্র নির্মাণ করে মানুষকে সিনেমামুখী করেছিলেন। সুস্থ ধারার বিনোদন দিয়ে বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রেম, বিরহ, ট্র্যাজেডি, কমিডি, ট্র্যাজিক-কমিডি, রোমান্টিক-কমেডি, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, কবিতা, গান, নাটকসহ নানা বিষয়ে এক ভিন্নমাত্রিক লেখা জাতিকে উপহার দিয়েছেন।

বহুব্রীহি, এসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার এর মতো মৌলিক এবং হৃদয়গ্রাহী লেখা খুব কম লেখকই উপহার দিতে পেরেছেন। জীবনের অনেক ছোট ছোট বিষয়কে কাব্যময় করে তুলতে পারতেন। তিনি যে চরিত্রগুলোর রূপায়ণ করেছেন সেগুলোর ওপর নির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শ চাপিয়ে দেননি। চরিত্রায়নে উদার নৈতিক দর্শন দৃশ্যমান। শেকস্‌পিয়ারের নাটকে সমাজের উচ্চবিত্তকে হিরোইজমের ভূমিকায় দেখা গেছে কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের নাটকে সমাজের মধ্যবিত্তদের হিরোইজমের ভূমিকায় দেখা গেছে। একজন মধ্যবিত্তের মধ্যেও যে হিরোইজম কাজ করতে পারে, তা তিনি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঙালিয়ানার গড় বৈশিষ্ট্য তার লেখনিতে উঠে এসেছে। পারিবারিক বলয়ে বাঙালি জীবনের গল্পগুলোকে তিনি শিল্পরূপ দিয়েছেন।

সিগমান্ড ফ্রয়েড মানুষের সাবকনসাস মাইন্ডের কথা বলেছেন, যেখানে মানুষ তাঁর কল্পলোকে বিরাজ করে। হুমায়ূন আহমেদ পাঠকের এই সাবকনসাস মাইন্ডকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি খুব সহজেই পাঠককে স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরিয়ে আনতে পারতেন। ভাষার সারল্যেও ভাবগাম্ভীর্য আর গভীরতা বজায় রেখেছেন। ধর্মীয় নিরপেক্ষতা, নারী-পুরুষের সাম্যভিত্তিক সমাজ চিত্রিত করেছেন। পুরুষতন্ত্র প্রাধান্য পায়নি তাঁর লেখায়। এমনকি ক্ষমতাবান নারীকেও তিনি পারিবারিক বলয়ের ভেতরে রেখেই উপস্থাপন করেছেন। মানুষ সহজাতভাবেই গল্প পছন্দ করে। কিন্তু সেই গল্পটি হওয়া চাই তার নিজের জীবনের মতো। প্রতিটি মানুষের জীবনের গল্প ভিন্ন কিন্তু সবার গল্পগুলো যেন একই সুতায় গাঁথা মালার মতো। হুমায়ূন আহমেদ ঠিক এ দর্শনটিই বুঝতে পেরেছিলেন।

ভিন্ন ভিন্ন গল্পগুলোকে সার্বিকীকরণ করে সবার মনের কথাগুলোকে কাব্যময় করে উপস্থাপন করেছেন। নিঃসঙ্গতা জীবনের একটি বড় অংশ। আর এটিকে হুমায়ূন তাঁর ‘তোমাকে’ উপন্যাসে দারুণভাবে চিত্রিত করেছেন। মানুষ অর্থবিত্তে সচ্ছল হলে বড়লোকিপানা দেখাতে পছন্দ করে। হুমায়ূন তাঁর ‘নক্ষত্রের রাত’ উপন্যাসে রেবেকার মার চরিত্রের মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ প্রাণ খুলে হাসতে চায়, গল্প শুনতে চায়, নিজেদের গল্প বলতে চায়।

আর সেটিই দশকের পর দশক ধরে করে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, মানুষ তাঁকেই মনে রাখে, যিনি বাঁক নিতে জানেন, নতুন পথের সন্ধান দিতে পারেন। শ্রোতা, দর্শক আর পাঠককে আকৃষ্ট করতে তাঁকে ভাঁড়ামি, অশ্লীলতা আর অযথা বাক্য বয়ানের প্রয়োজন হয়নি। চরিত্রায়নের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা, সহমর্মিতা, স্নেহ আর হাস্যরসের মাধ্যমে একধরনের বৈচিত্র্যময় নান্দনিকতা তৈরি করতে পারতেন।

‘এই সব দিনরাত্রি’ এবং ‘আজ রবিবার’ নাটকে তিনি যৌথ পরিবারের বন্ধনকে তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। ‘নিমফুল’ নাটকে ডাকাতের চোখ তোলা হবে বলে  চরম কর্মযজ্ঞের আয়োজন হয়েছিল এবং দর্শকদের মধ্যে চরম আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু শেষ দৃশ্যে তাঁকে পুলিশের মুখোমুখি করে স্বস্তির জায়গা তৈরি করলেন। চরম ক্ষ্যাপাটে চরিত্রকেও তাঁর নাটকে অতি মানবিক রূপে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। কোথাও কেউ নেই নাটকে এমনটি দেখা গেল। তিনি নির্জলা সত্যের আড়ম্বরহীন উপস্থাপন করতে পারতেন। নেতিবাচক চরিত্রেও যে ইতিবাচক কিছু দিক থাকে, তা তিনি দেখিয়েছেন কোথাও কেউ নেই নাটকে।

মন্দতেও ভালো কিছু থাকে এটি আমরা শেকস্‌পিয়ারের নাটকেও দেখি। তার বিখ্যাত একটি লাইন ‘Sweets are the uses of adversity. এখানে নাট্যকার মন্দের মধ্যে ভালো গুণ আবিষ্কার করেছেন। মিসির আলী, হিমু, শুভ্র চরিত্রগুলোকে সাদা চোখে হয়তো মূল্যহীন মনে হবে। কিন্তু বাস্তব জীবনে যা করা সহজ নয়, তারা তাই করে দেখিয়েছে। এ জন্যই এ চরিত্রগুলো সর্বকালের প্রতিরূপ। জীবন ঘনিষ্ট বিষয়ের অপূর্ব দৃশ্যায়ন বা চিত্রায়ন করতে পারতেন। তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার লেখনিতে চরিত্রের রূপায়ন পাঠকের বিষণ্ন মনকে ম্যাজিকের মতো প্রশান্তি এনে দিয়েছে।

হুমায়ূন আহমেদের লেখনি দেশের পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর রচিত সমুদ্রবিলাস উপন্যাসের মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপটি বিশ্ব পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর ‘দ্বারুচিনি দ্বীপ’ প্রকাশের পর সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এমনই একজন লেখক যিনি তাঁর লেখনির মাধ্যমে একটি জাতীয় রুচি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তাঁর সহজাত কাব্যিক প্রকাশ পাঠককে মুগ্ধ করত। খুব বেশি কবিতা তিনি লেখেননি। তবে তাঁর গৃহত্যাগী জোছনা কাব্য সংকলনটি ১৯৯৬ সালে প্রকাশের পর পাঠক একটি ভিন্ন স্বাদের কাব্য উপহার পেয়েছিল।

লেখক: মাজহার মান্নান, কবি ও প্রাবন্ধিক এবং সহকারী অধ্যাপক, বি এ এফ শাহীন কলেজ কুর্মিটোলা, ঢাকা সেনানিবাস