চীন কি অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনুকরণীয় হতে পারে
চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ অনেক কিছু শেখা ও জানার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। কারণ, চীন আজ বিশ্বে ও উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ যে কোনো জিনিস চীন আজ নিজেই তৈরি করতে পারে। চীনের তৈরি যেকোনো মালামাল আজ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব ছোটবড় দেশে স্থান করে নিয়েছে। যা নিজ চোখে দেখে না আসলে বুঝানো মুশকিল। দেশটিতে নেই কোনো হাহাকার, মারামারি বা কাটাকাটি। আছে শুধু কাজ আর কর্ম। এই সেদিন কিছুদিনের জন্য আমি চীনের রাজধানী বেইজিং, চাংচুং এবং কুনমিংয়ে চায়না ইউনেস্কো ক্লাবের বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে দেশটিকে খুব কাছ থেকে দেখে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছি, তাতে নিজেই আমার বাংলাদেশকে নিয়ে হতাশ।
আমাদের দেশের রাজনীতি ধ্বংসের আর চীনের রাজনীতি উন্নয়ন ও অগ্রগতির। তাদের রাজনীতিতে কোনো মিথ্যা বুলি, হিংসা, বিদ্বেষ, হত্যা, গুম, অহংকার-অহমিকা, কুৎসা রটনা—এর কিছুই নেই। আছে ভালোবাসা, মহব্বত, স্নেহ-মমতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। তবে চীনে সাধারণত পুরুষের থেকে নারীর সংখ্যা সর্বক্ষেত্রে বেশী দেখতে পেলাম। পরিশ্রমী এবং কঠোর শৃঙ্খলা বজায় রেখে তারা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে থাকে, অনেকটা জাপানিদের মতো। তবে তাদের মধ্যে একটু রাগ ও ক্রোধের মনোভাব দেখতে পেলাম। কাজে ফাঁকি দেওয়াকে তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। সময়মতো বাস, ট্রেন, উড়োজাহাজ সবকিছুই চলছে তার নিজস্ব গতিতে। যার যা দায়িত্ব, সে নিজে নিজেই নীরবে করে যাচ্ছে। কাউকে দোষারোপ করছে না।
বৃহৎ দেশ হিসেবে আমেরিকাকে টক্কর দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা তাদের সর্বত্র কাজ করে। তবে চীনের মানুষের মধ্যে মাও সেতুং–এর মতো মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কোনো কমতি নেই বললেই চলে। বিমানভর্তি বহু বাংলাদেশি ব্যবসায়ীকে চীন হতে কাপড়, কেমিক্যাল, খেলনা থেকে শুরু করে কত রকম মেশিনারি আমদানির কথা শুনতে পেয়ে আমিই নিজেই হতবাক। অন্যান্য দেশ হতে চীনের জিনিসপাত্রের দাম মোটামুটি সস্তা। তবে গুণগত মান কেমন তা আমার জানা নেই। চীন আজ নিজ দক্ষতায় জাতিসংঘসহ বিশ্ব দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। দেশটিতে নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখে অবাক। তারা অনেকে বিদেশি ভাষা ইংরেজি জানে না তারপরও বিশ্ব ব্যবসায় চীন এখন শীর্ষে। বাংলাদেশি হিসেবে আমরা অনেক ক্ষেত্রে চীনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের এই ক্ষুদ্র এবং জনসংখ্যাসমৃদ্ধ দেশটির উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালানোর কোনো বিকল্প দেখি না। মাদক ও নোংরা রাজনীতিতে আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীরা জর্জরিত। শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র সমাজের যে আচরণ তাতে দেশবাসী ক্ষুদ্ধ এবং আতঙ্কিত আর চীনের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো রকম রাজনীতি নেই। আইনের প্রতি সকলেই শ্রদ্ধাশীল। সেখানে সরকার বা সরকারি দলের কোন হস্তক্ষেপ নেই।
চীনে যে জিনিসটি দেখে মুগ্ধ হলাম, তা হচ্ছে সাইকেল। ছেলে-মেয়ে বা নারী-পুরুষ হোক, সবাই সাইকেল চালিয়ে স্কুল-কলেজ বা কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করছে। তবে সে দেশের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে খোলামেলা পোশাক পরিধান থাকা সত্ত্বেও পত্রপত্রিকায় ধর্ষণের শিকার হতে কোনো সংবাদ চোখে পড়েনি। রাজধানী বেইজিং শহরের থেকে কুনমিং ও চাংচুং শহরকে আরও আধুনিক, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন মনে হলো। বহু বাংলাদেশিকে কুনমিং শহরে দেখা গেল ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। তবে বেইজিং শহর ব্যস্ততম নগরী হিসেবে মনে হলো। পরিশ্রম, জ্ঞান-বুদ্ধি, দক্ষতার মাধ্যমে চীনকে সবার উপরে ওঠার যে প্রবণতা দেশটিতে দেখতে পেলাম, তাতে আমি নিজেই প্রশংসা না করে পারছি না। কারণ, তাদের আগ্রহ ও চেষ্টার কোনো ঘাটতি দেখতে পাইনি। আর বাংলাদেশি হিসেবে অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজও তার লক্ষ্য অর্জনে বার বার বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এটার জন্য দুর্নীতি ও রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। চীনেরও প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ আর আমাদেরও প্রধান খাদ্য ভাত-মাছ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ কবে একটি সুশৃঙ্খল দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে, তা বলা মুশকিল। সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি করে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক চাকাকে বার বার বাধাগ্রস্থ করছে তা আমাদের দেশেরটি পলাতক সরকারের দিকে তাকালেই বুঝে ওঠা সম্ভব।
চীন সুই থেকে আরম্ভ করে কি-না তৈরি করতে পারে। আজ তারা কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল, টিভি ফ্রিজসহ ইলেকট্রনিক যে কোনো বস্তু অত্যন্ত সস্তায় নির্মাণ করে বিশ্ব বাজারে তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছে। চীন সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও দক্ষ জনশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাত্র ৫০ বছরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে সক্ষম হয়েছে। চীন থেকে বাংলাদেশ অনেক কিছু অভিজ্ঞতা অর্জনে প্রচেষ্টা চালাতে পারে, তাহলে হয়তো একদিন বাংলাদেশও চীনকে ছাড়াতে পারবে। তবে চীনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশ হতে সর্বপ্রথম দুর্নীতি দূর করতে হবে। সুইস ব্যাংকসহ দেশের বাহিরে দুর্নীতিবাজ বাংলাদেশিদের যে হারে অর্থ জমা আছে তা ফেরৎ আনতে পারলে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে চীনের মতো কাজে লাগাতে পারলে আমরাও বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব এবং দূর করতে পারব সব রকম দারিদ্র্য।
বর্তমানে মাও সে–তুং বা চৌ এন লাইয়ের চীন এখন আর নেই। তাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার পেছনে চীনের জনগণের অবদান যথেষ্ট। সাধারণ মানুষের মধ্যে জামা-কাপড়ের তেমন লক্ষণীয় কিছু নেই। একটা গেঞ্জি বা শার্ট–প্যান্ট পরে ছেলেমেয়ে বুড়ুবুড়ি—সবাই কাজ করছে। তবে শিল্প উন্নয়নে বর্তমানে চীন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সভ্যতা এবং আতিথেয়তা তাদের আগের থেকে অনেক উন্নতি লক্ষ করতে পেরেছি। তবে ইংরেজী শেখার প্রতি এখন তাদের প্রবল আগ্রহ এবং চেষ্টা দেখে আমি অভিভূত।
চীনের চাংচুর শহরের ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড মাল্টিকালচ্যারাল এডুকেশন সেন্টারে ইউনেস্কোর প্রোগ্রামে বহু দেশি-বিদেশির পাশাপাশি হাজারো চীনা ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শীতা দেখে আমিই নিজেই মুগ্ধ। তাদের ভাষ্য দেশ ও জাতির উন্নয়নে চীনকে তার নিজস্ব ভাষার বাহিরে যেতে হবে তাহলে অনেক কিছু শিখতে এবং জানার সুযোগের মাধ্যমে বিশ্বে চীন তার অধিকার অর্জন করতে সক্ষম হবে। তাই চীনারা আজ বিশ্ব বাজারে নিজেদের গড়ে তোলার স্বার্থে ইংরেজি ভাষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে যা তাদের নিকট আনন্দের সংবাদ। অবাক হয়েছি চীনের ছেলে-মেয়েদের সাংস্কৃতিক চর্চা দেখে। নিখুঁত এবং আকর্ষণীয় পারফরমানেন্সের মাধ্যমে চীনা সাংস্কৃতিককে তুলে ধরার যে প্রচেষ্টা তা সত্যিই অতুলনীয়। চীন শুধু বৃহৎ রাষ্ট্রই নয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে সে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলছে। সমাজতন্ত্র থেকে চীন বের হয়ে বর্তমানে আধুনিক চীন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। তাই চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও জোরদার করতে পারলে চীন হতে আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারব তা আমাদের দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে সক্ষম হবো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই তো অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীন হতে পারে অনুকরণীয়।
*লেখক: মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী, গণমাধ্যমকর্মী ও ভ্রমণপিপাসু