স্বপ্নের বিশ্বকাপটা আমরা কখন দেখব

ফাইল ছবি

সারা পৃথিবী আজ ফুটবল-জ্বরে কাঁপছে। আর বাংলাদেশ তো শুধু জ্বরে নয়, বরং বলা যায় জ্বরের সঙ্গে ফুটবলের উচ্চ রক্তচাপে কাঁপছে। এতটাই আক্রান্ত যে রক্তচাপ কোনোমতেই নামতে চাচ্ছে না। কেবলই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। যেদিকেই চোখ যায়, শুধু পতাকা আর পতাকা। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকায় ছেয়ে গেছে দেশ। কে কত বড় পতাকা ওড়াবে, তারই প্রতিযোগিতা চলছে দেশে।

শুধু পতাকা ওড়ানোই নয়, চলছে যার যার পছন্দের দলের পক্ষে মিছিল, শোভাযাত্রা ইত্যাদি। ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা তাঁদের দল জিতলেও রাস্তায় নামে আবার হারলেও রাস্তায় নামে। জিতলে তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাস্তায় নামে। আবার আর্জেন্টিনা হারলে ব্রাজিলের সমর্থকেরা বা ব্রাজিল হারলে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা আনন্দে রাস্তায় নামে।

চায়ের দোকান, রাস্তার মোড়, স্কুল-কলেজ বা বাজার, বাসে, ট্রেনে—সব জায়গায়ই আলাপ-আলোচনার একটা বড় অংশজুড়েই আছে বিশ্বকাপ ফুটবল। আর ফেসবুক যুদ্ধে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা তো একে অপরকে খোঁচা দেওয়ার নিত্যনতুন কৌশল ব্যবহার করছেন। এককথায়, বিশ্বকাপকে ঘিরে সব ক্ষেত্রেই চলছে এক বিশাল উন্মাদনা।

অবশ্য এই অবস্থা রাতারাতি তৈরি হয়নি। বিশ্বকাপে পৃথিবীর সেরা ফুটবলাররা খেলেন। তাই এর আবেদন সব সময়ই ছিল। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন এর প্রচার-প্রচারণা শুধু পত্রিকা আর রেডিও-টেলিভিশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। আর বর্তমানে অ্যান্ড্রয়েড ফোন আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে বিশ্বকাপের প্রচারণায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অনেক বিষয়।

ফিফার তো টুর্নামেন্টটাকে জমজমাট করার জন্য প্রচারণা চালানো দায়িত্বই। প্রিন্ট মিডিয়া চমকপ্রদ সব তথ্য দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা চালায়। টিভি চ্যানেলগুলো তাদের দর্শক বাড়ানোর জন্য দারুণ সব কৌশল ব্যবহার করে।

ফাইল ছবি

ক্রীড়াসামগ্রীর কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের চাহিদা বাড়ানোর জন্য বিশ্বকাপের সময় আকর্ষণীয় সব প্রচারণা চালায়। এ সব মিলেই তৈরি হয় উন্মাদনা। আর আমাদের দেশে তো হুজুগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

একবার হুজুগ সৃষ্টি করতে পারলেই হলো, আর ফেরানোর সাধ্য কার? এ জন্যই বিশ্বকাপের মূল পর্বে আমাদের দল না থাকলেও আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে সমঝদার দর্শক। আমাদের পছন্দের দল জিতলে আমরা আনন্দে আত্মহারা হই। আবার হারলেও আত্মঘাতী হই। উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের অনেক অতিউৎসাহী দর্শকের হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। আমাদের দল বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে থাকা না থাকা এখানে কোনো ফ্যাক্টর নয়।

বাঙালি খেলাপাগল জাতি। বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বের সময় বাংলাদেশ উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। আমি আগেই বলেছি, এ উৎসবমুখরতা অনেক ক্ষেত্রে উন্মাদনায় রূপ নেয়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ তখন বিশ্বের নামকরা দলগুলোর (বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের) কট্টর সমর্থক হয়ে যায়। এ সময় বিশ্বকাপে আমার প্রিয় দল সম্পর্কেও অনেকেই জানতে চায়। আমি খুব সহজ প্রশ্নটির স্বাভাবিক উত্তর দিই।

বলি, আমার প্রিয় দলটি হলো বাংলাদেশ। প্রশ্নকারী আশ্চর্য হয়। আপনারাও হয়তো আশ্চর্য হয়েছেন। হয়তো বলবেন, বাংলাদেশ তো বিশ্বকাপে খেলে না। কথাটা একদমই ঠিক না। বাংলাদেশ প্রতি বিশ্বকাপেই খেলে। সত্যিকার অর্থেই খেলে। চূড়ান্ত পর্বে আজ পর্যন্ত উঠতে পারেনি কথাটি ঠিক আছে, কিন্তু বাছাইপর্বে বাংলাদেশ তো প্রতিবছরই খেলে। বিশ্বকাপের শুরুটা তো বাছাইপর্ব থেকেই। কোনো দেশ বাছাইপর্ব থেকে বিদায় নেবে। কোনো দেশ গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেবে। কোনো দেশ সেকেন্ড রাউন্ড থেকে বিদায় নেবে। কোনো দেশ কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেবে। কোনো দেশ সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেবে।

কোনো দেশ ফাইনাল থেকে বিদায় নেবে। চ্যাম্পিয়ন হবে তো একটি দেশ। তাতে তো কোনো সমস্যা নেই। আমি বাংলাদেশের চূড়ান্ত ও কট্টর সমর্থক। মনপ্রাণ উজাড় করে দেওয়া সমর্থক। চূড়ান্ত পর্বে আমার দেশ খেলুক বা না খেলুক, আমার এই সমর্থনের ভাগ অন্য দেশকে দিতে যাব কেন?

স্বপ্ন দেখি, আমার দেশও একদিন বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলবে। কেমন হবে সেই দিনটা? আমার ধারণা, সেদিন এ দেশের কোটি কোটি মানুষ কাজকর্ম বাদ দিয়ে, দোকানপাট বন্ধ করে, স্কুল-কলেজ ছুটি দিয়ে টেলিভিশনের সামনে বসবে। আর স্টেডিয়াম? সেখানে লাল-সবুজ পতাকা হাতে থাকবে অগণিত বাংলাদেশের সমর্থক। আমার চোখের সামনে ভাসছে দৃশ্যটা। আমাদের একজন স্ট্রাইকার বল নিয়ে প্রতিপক্ষ দলের গোলপোস্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের হাজারো সমর্থক ‘গোল গোল’ বলে চিৎকার করছে। একপর্যায়ে গোলও হয়ে গেছে। স্টেডিয়ামে আমাদের সমর্থকদের সে কী উল্লাস! চারদিকে শুধুই ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ ধ্বনি।

আমার কথায় আপনাদের হাসি পাচ্ছে, তাই না? আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, একসময় আমাদের ক্রিকেট দলকে নিয়েও অনেকেই হাসাহাসি করত। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলটি ছিল একেবারেই সাধারণ মানের একটি দল। তখন ভারত বা পাকিস্তান দলকে বাহবা দেওয়ার লোকের অভাব এ দেশে ছিল না। সে তুলনায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সমর্থন যে শুধু কম ছিল তা-ই নয়; বরং আমাদের দলটাকে নিয়ে নাক সিটকানোর লোকের অভাব এ দেশেই কম ছিল না।

আর এখন যখন আমাদের ক্রিকেট দলটা বিশ্বমানের দল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, তখন কিন্তু এ দেশের মানুষ একবাক্যে আমাদের দলটাকে নিয়েই মাতামাতি করছে। কিন্তু আমার ভাবনাটা একটু অন্য রকম। আমার দেশ হারুক বা জিতুক, সব সময় দেশের পাশেই থাকি। ক্রিকেটের কোনো ম্যাচে যখন বাংলাদেশ দলের শেষ বলে ১২ রান লাগে তখনো হতাশ না হয়ে জয়ের প্রত্যাশায় বসে থাকি আমি। মনে হয়ে শেষ বলটা নো বল হবে। আর আমাদের ব্যাটসম্যান এ বলে ছক্কা মারবে।

পরবর্তী বলে আরও একটা ছক্কা মেরে আমাদের দল জিতে যাবে। যাক সে কথা। শুধু পুরুষ ক্রিকেট কেন, মহিলা ক্রিকেটেও তো বাংলাদেশ যে নিকট ভবিষ্যতেই বিশ্ব শাসন করবে, এমন ইঙ্গিত স্পষ্ট। আমাদের মেয়েরাও তো ফুটবলে এগিয়েই যাচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা যদি ভালো একটা ফুটবল দল দাঁড় করাতে পারি, তবে এ দেশের কেউ আর বিদেশের ফুটবল দল নিয়ে ভাববে না, মাতামাতি করবে না। এ দেশের মাটিতে আর কোনো দিন বিদেশি পতাকাও উড়বে না। এখন আমাদের ভালো দল না থাকায় আমরা এতিমের মতো এদল-ওদলের সমর্থন করছি। দুধের স্বাদ আমরা ঘোলে মেটাচ্ছি, এই যা।

এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে আমরা কি শুধু দর্শক হয়েই থাকব? আমার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় যে ভবিষ্যতেও বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলবে না বাংলাদেশ। যে জাতি লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, তার একটা ভালো ফুটবল দল থাকবে না, সেটা কী করে সম্ভব? যে দেশ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সাহস করতে পারে, লাখ লাখ অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানকে আশ্রয় দিতে পারে, নিজস্ব অর্থায়নে মর্যাদাবান স্যাটেলাইট ক্লাবের সদস্য হতে পারে, তার একটি ভালো ফুটবল দল থাকবে না, সেটা তো হতে পারে না।

আমার বিশ্বাস, আমরা অবশ্যই পারব। শুধু প্রয়োজন ফুটবলকে নিয়ে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা নেওয়ার। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালানোর। এর সঙ্গে আর দরকার একটু স্বপ্ন দেখার, আর একটু স্বপ্ন দেখানোর। আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই তো আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তো স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখেন উন্নত বাংলাদেশের।

স্বপ্ন দেখতে যদি ভুলে যাই, তবে জীবনটাই তো থেমে যাবে। সামগ্রিকভাবে থেমে যাবে দেশের অগ্রযাত্রা। তাই স্বপ্ন দেখাটা খুব দরকার। ফুটবল বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার জন্য আমাদের দরকার কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ ফুটবলার খুঁজে বের করার। যে তরুণ প্রজন্ম আজ বিদেশি ফুটবল নিয়ে আর বিদেশি পতাকা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশে ব্যস্ত, তাদেরই নিজের দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখাতে হবে। কোটি কোটি মানুষের দেশ থেকে এগারো জন ভালো ফুটবলার বের হবে—এমনটা আশা করা তেমন অস্বাভাবিক কিছু বিষয় নয়।

ক্রিকেটে আমাদের ছেলেরা যদি পারে, তবে ফুটবলে তারা পারবে না কেন? আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের ফুটবলারদের স্বপ্ন দেখাতে পারলে, তাদের নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে এগোতে পারলে, আমরাও একদিন ফুটবলের বড় আসরের সবুজ মাঠে মাথা উঁচু করে নিজেদের লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে দৌড়াতে পারব।

আমাদের ছেলেরা বিশ্বকাপে খেলবে, আমাদের জাতীয় পতাকা ওড়াবে, আমাদের জাতীয় সংগীত গেয়ে চোখের পানি ফেলে প্রতিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে জেতার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে খেলায় নেমে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করবে—এমন একটা স্বপ্নের বিশ্বকাপ দেখতে চাই। দেখতে পারব তো এমন একটা বিশ্বকাপ? রইলাম সেদিনের অপেক্ষায়।

লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত), মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা।