চট্টগ্রামের দক্ষিণ নালাপাড়া পূজামণ্ডপে ‘ছৌ কলায় লঙ্কাকাণ্ড’

ঐতিহ্যবাহী ছৌ নৃত্য আর রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডকে সমন্বিত করে চট্টগ্রামের দক্ষিণ নালাপাড়ায় পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ এবার তাদের পূজার ‘থিম’ ঠিক করেছে হয়েছে ‘ছৌ কলায় লঙ্কাকাণ্ড’ছবি: লেখকের পাঠানো

ছৌ কলা বা ছৌ নাচ হলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড ও ওডিশা অঞ্চলে প্রচলিত এক বিশেষ ধরনের আধা শাস্ত্রীয় লোকনৃত্য, যা মার্শাল আর্ট ও লোককথার উপাদান নিয়ে গঠিত। এটি ‘ছায়া’ বা ‘শৌভিক’ শব্দ থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয় এবং মুখোশ পরিহিত শিল্পীরা শারীরিক কসরতের মাধ্যমে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লোকচরিত্রের রূপ ফুটিয়ে তোলেন। প্রধান তিনটি ধারা হলো পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া ছৌ, ঝাড়খন্ডের সরাইকেলা ছৌ এবং ওডিশার ময়ূরভঞ্জ ছৌ।

২০১০ সালে ছৌ নৃত্য ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নেয়।

আর রামায়ণের ‘লঙ্কাকাণ্ড’ হলো যুদ্ধের পর্ব। সীতা হরণের পর তাঁকে উদ্ধারে লঙ্কায় যাওয়া রাম ও লঙ্কাপতি রাবণের মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধ হয় এ পর্বে। লঙ্কাকাণ্ডে রাবণ বধের পর তাঁর ভাই বিভীষণকে লঙ্কার রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করেন রাম। রাবণ বধের আগে শরৎকালে দেবী দুর্গার বোধন করেছিলেন তিনি। তাই শরতের এই দুর্গাপূজা পরিচিতি পায় ‘অকালবোধন’ নামে।

এক দিকে দশভুজা, অন্যদিকে দশানন—সবার পরনে ছৌ নাচের কস্টিউম!

পূজার বাদ্য নয়, যেন নৃত্যযুদ্ধের দামামা বাজছে। দক্ষিণ নালাপাড়ায় পূজামণ্ডপ যেন একটুকরা লঙ্কা।

ঐতিহ্যবাহী ছৌ নৃত্য আর রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডকে সমন্বিত করে চট্টগ্রামের দক্ষিণ নালাপাড়ায় পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ এবার তাদের পূজার ‘থিম’ ঠিক করেছে হয়েছে ‘ছৌ কলায় লঙ্কাকাণ্ড’।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সদস্যরা জানান, ছৌ নৃত্যের মাধ্যমে যেসব ধর্মীয় আখ্যান পরিবেশিত হয়, তার মধ্যে কৃত্তিবাস ওঝার ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ বা শ্রী রাম পাঁচালীর ষষ্ঠ খণ্ড ‘লঙ্কাকাণ্ড’কে তারা তাদের পূজার উপজীব্য করেছেন।

চট্টগ্রামের সর্বজনীন এ পূজামণ্ডপের বয়স এবার ৭৭ হয়েছে। প্রতিবারই বৈচিত্র্যময় ভাবধারায় সাজিয়ে তোলা হয় এ মণ্ডপ। এবারের পূজার ‘থিম’ ব্যাখ্যা করে পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সদস্য রাজীব বিশ্বাস রাজা বলেন, ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণের মাধ্যমে আমরা এ বছর বার্তা দিচ্ছি—দুষ্টের দমন, ধর্মের বিজয়কে। যেটি বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে খুবই প্রয়োজনীয় বলে আমরা মনে করছি। এ কারণে এবার আমরা আমাদের থিমের নাম দিয়েছি “ছৌ কলায় লঙ্কাকাণ্ড”।’

গত ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিন সূচনা হয়েছে দেবীপক্ষের, আগামী ৬ অক্টোবর কোজাগরী পূর্ণিমার মধ্য দিয়ে এ পক্ষের শেষ হবে। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন হয় দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। আশ্বিন মাসের এই শুক্লপক্ষকেই দেবীপক্ষ বলা হয়। ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় দেবীর নিদ্রাভঙ্গের বন্দনায় শুরু হয় বাঙালি হিন্দুদের প্রধান এ ধর্মীয় উৎসবের, যার সাঙ্গ হয় বিজয়া দশমীতে।

মণ্ডপে দুর্গাপ্রতিমার পাশাপাশি ছৌ নৃত্যের আদলে মুখোশ আর রণসজ্জায় দেখা গেল অন্য দেবদেবীদের
ছবি: লেখকের পাঠানো

গত শনিবার রাতে দক্ষিণ নালাপাড়া পূজামণ্ডপে গিয়ে দেখা যায়, আয়োজক ও শিল্পীদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। মণ্ডপে দুর্গাপ্রতিমার পাশাপাশি ছৌ নৃত্যের আদলে মুখোশ আর রণসজ্জায় দেখা গেল অন্য সব দেবদেবীকে।

মণ্ডপের প্রবেশপথে দেবী দুর্গাকে দেখা যায় শরতের কাশবন আর ধানখেত পেরিয়ে হেঁটে যেতে। এ যেন বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে পুরুলিয়ার ছৌ আর পৌরাণিক কাহিনীর এক অনন্য মেলবন্ধন।

আয়োজকেরা জানান, তাঁদের পূজামণ্ডপের এবারের সৃজন ভাবনায় আছেন শিল্পী বিশ্বজিৎ আইচ। প্রতিমা তৈরি করেছেন উত্তম পাল। আর আলোকসজ্জা করেছে নাট্যশোভা।

পূজা কমিটির সদস্য রাজীব বিশ্বাসের আশা, অতীতের মতো তাঁদের এবারের পূজার ভাবনাও দর্শনার্থীদের মধ্যে সাড়া ফেলবে। রাজীব বিশ্বাসের দাবি, মণ্ডপে তাঁদের যে আলোকসজ্জা, সেটাও পরিবেশবিরুদ্ধ নয়। পরিবেশবান্ধব সাধারণ লাইটের মাধ্যমে ‘অসাধারণ কিছু’ চিত্রায়ণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি জানান, প্রতিমা ও মণ্ডপের সাজসজ্জায় এবার মাটি, চট ও গাছের বাকল ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিমার পোশাক–পরিচ্ছদ বা অবয়বে ছৌ নৃত্যের শিল্পীদের প্রতীকী ভাব রাখা হয়েছে পুরোপুরিভাবে। তিনি বলেন, ‘আগে ব্যক্তিগতভাবে পূজা আয়োজন করা হলেও ১৯৪৭ সাল থেকে দক্ষিণ নালাপাড়ায় সর্বজনীন পূজা হয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে আমরা বৈচিত্র্যময় কিছু করার চেষ্টা করি। এবারও সে ধরনের চিন্তা থেকে ছৌ কলায় লঙ্কাকাণ্ড বিষয়টি উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।’

  • অজয় মিত্র, চট্টগ্রাম