বাবা আমাকে পড়তে শিখিয়েছেন

অলংকরণ: তুলি

ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে আমার প্রথম যে স্মৃতি মনে পড়ে তা হলো, আমি বাবার লাইব্রেরিতে বসে আছি। লাইব্রেরির পুরোনো ধুলাপড়া মানচিত্র ধরে বাবা আমাকে দেশের নাম চেনাচ্ছেন। আমি দেশের নাম-অবস্থান ভুলে যাচ্ছি। বাবা ভুল ধরে বলছেন, আরে বোকা! মাদাগাস্কার এপাশে না, এটা আফ্রিকার নিচের দিকে। রাশিয়া পড়েছে ইউরোপে, এশিয়ায় না।

বাবার অফিসে তিনটা পত্রিকা আসত। টিফিনের সময় তিনি পত্রিকার সঙ্গের ট্যাবলয়েডগুলো পকেটে গুঁজে নিয়ে আসতেন। কিন্ডারগার্টেনে পড়ুয়া আমার জন্য সেগুলো ছিল সবচেয়ে বড় উপহার। আর প্রতি ঈদে ঈদসংখ্যা তো থাকতই। এভাবে গড়পড়তা অন্য যেকোনো ছেলেমেয়ের চেয়ে অনেক আগেই আমার বইপড়ার অভ্যাস হয়েছিল। সে জন্য আমি বাবার কাছে ঋণী। বাবা আমাকে পড়তে শিখিয়েছেন।

আমি তখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। বাবা কিছুদিন আগেই মাত্র এমএ পরীক্ষা দিয়েছেন। তাঁর চাকরির সুবাদে আমরা চলে এসেছি নারায়ণগঞ্জে। বাবা তখনো প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকায় এসে টিউশনি করাতেন। আমাকে নিয়ে আসতেন তাঁর সঙ্গে। আমাদের প্রতি সপ্তাহের রুটিন ছিল টিউশনি শেষে রমনা-শাহবাগের চারপাশে ঘোরাঘুরি, শিশুপার্কের ট্রেনে চড়া আর একটা বার্গার খেয়ে বাসায় ফেরা। আমি বাসে উঠতে চাইতাম না। তাই গুলিস্তানে নেমেই বাবা রিকশা নিতেন। দোয়েল চত্বর শিল্পকলার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাবা আমাকে চেনাতে—ই যে এটা কার্জন হল, এখানে বিজ্ঞানের ক্লাস হয়, এটা জাতীয় শহীদ মিনার, এটা জাতীয় কবির মাজার, এটা কলাভবন। প্রতিবার আসার সময় বাবা একইভাবে আমাকে চেনাতেন সবকিছু। প্রথম সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, এটাই হয়তো ছিল বাবার চাওয়া।

একবার ঈদের দিন সকালে বাবা বললেন, চল, এবার ঈদের নামাজ জাতীয় ঈদগাহে পড়ব। পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে আমরা বাসে করে চলে এলাম ঈদগাহে। দেরি করে আসায় ভেতরে ঢোকার তো আর সুযোগ হলো না। পথের ওপরেই আমরা চাদর বিছিয়ে নামাজ সেরে নিলাম। নামাজ শেষে সেবার আমরা অনেক ঘুরলাম। জাতীয় ঈদগাহের খুব কাছেই কবি সুফিয়া কামালের বাড়ি। গেটের পাশে নেমপ্লেট দেখাতেই আমি অবাক। আমাদের বইয়ের কবির বাড়ি এটা! ছুটির দিনগুলোতে বাবার সঙ্গে যেতাম জাতীয় জাদুঘর, গ্রন্থাগার নয়তো নীলক্ষেতে বইয়ের খোঁজে। পথ চলতে আমার সঙ্গে গল্প করতেন একেবারে বড় মানুষের মতো। আমার চিন্তা আর দেখার চোখ খুলে দিয়েছিলেন বাবা।

গ্রন্থাগারিক বাবার সুবাদে আমাদের বাসায় বইয়ের ভালো সংগ্রহ পেয়েছিলাম। পত্রিকা আর গল্পের পর বাবা জীবনী পড়ার ওপর বেশি জোর দিতেন। মনে আছে, বাবা আমাকে ইবনে সিনার একটা জীবনী এনে দিয়েছিলেন। সেখানে একটা লেখা ছিল এমন, ইবনে সিনা প্রতিদিন অন্তত ৪৮ পৃষ্ঠা মৌলিক রচনা লিখেছেন। কথাটা আমার মনে খুব ছাপ ফেলেছিল। পড়াশোনা আর লেখালেখিতে এতটা বিখ্যাত হওয়া যায়! খুব ছোটবেলায় আমি কবি জসীমউদ্‌দীন, বেগম রোকেয়া, কবি শামসুর রাহমান, এস এম সুলতানদের জীবনী জানতাম। নড়াইলের পুরুলিয়া গ্রামে চিত্রা নদীর তীরে শিল্পী সুলতান ভাবুক হয়ে বসে থাকতেন। ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে জসীমউদ্‌দীনের গ্রামীণ জীবন আমাকে খুব করে টানত। ছুটিতে গ্রামে গেলে মনে মনে পল্লিকবির মতো করে গাছপালা আর ফুলের নাম জানার চেষ্টা করতাম। কবি আর শিল্পীদের মতো জীবন কাটাব, এমনটাই ভাবতাম শৈশবে।

বাবা একটা সময় খুব বিরক্ত হতেন আমার ওপর। মাধ্যমিকের শেষ বছরগুলোতে পড়াশোনা একদম কমিয়ে দিয়েছিলাম। পড়ার টেবিলের চেয়ে বেশি সময় দিতাম নানান উৎসব-অনুষ্ঠান আর প্রতিযোগিতায়। বিতর্ক, আবৃত্তি, রচনা প্রতিযোগিতায় বাবা খুশি হতেন। কিন্তু তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখতে পেতাম। বাবা খুব করে চাইতেন আমি চিকিৎসক হবো। বলতেন, দেখো তোমাকে সাহিত্য পড়তে দিয়েছি বলে বিজ্ঞান পড়া ছেড়ে দিয়ো না।

কিন্তু বাবার সে কথা আমি রাখতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত জীবন আমাকে খুব করে টানত। দুবারের দৌড়ঝাঁপের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সাংবাদিকতায় যুক্ত হই। পত্রিকার পাতায় আমার লেখাগুলো বাবা কেটে কেটে যত্নœকরে রাখেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নটা পূরণ করতে পারিনি বলে সামনে দাঁড়াতে আমার লজ্জা হয়। বাড়িতে গেলে এখন আর আগের মতো আমার পড়াশোনার খোঁজ নেন না। একসঙ্গে বের হই না অনেক দিন হলো। বাবার এভাবে বয়স বেড়ে যাওয়া দেখে আমার শঙ্কা হয়। কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের মতো আমিও প্রার্থনা করি, ‘বাবা যেন এক শ বছর বাঁচে।’
লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়