যদি ফিরে আসতেন সালমান শাহ!

সালমান শাহ
ফাইল ছবি

‘বাবা বলে ছেলে নাম করবে

সারা পৃথিবী তাকে মনে রাখবে...

শুধু এ কথা, কেউ জানে না

আগামী দিনের ঠিকানা...

বাবা বলে ছেলে নাম করবে...

জনপ্রিয় এবং অনুপম আদর্শের শ্রেষ্ঠ ধারক কণ্ঠশিল্পী খান আসিফুর রহমান আগুনের কণ্ঠে গাওয়া এ গানের প্রতিটি কথায় জড়িয়ে আছে হাজার উৎসাহ-উদ্দীপনা, প্রাণচঞ্চতা, একটু এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়প্রত্যয়, ভালোবাসা এবং রোমাঞ্চের উন্মাদনা। গানটি শুনলে দেশের লাখো তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী যেমন অনেক বেশি উৎসাহ পায়। এ গান, গানের সুর এবং আবহটাকে এতটুকু সার্থক করার মূলে যে মায়ের সন্তানটির পদচারণ ছিল, এতটুকু সরব সে মহানায়কতুল্য সন্তানটি আজ আমাদের মাঝে নেই। হ্যাঁ, পাঠক, আমি বাংলার চলচ্চিত্রের মহানায়ক প্রয়াত সালমান শাহর কথা বলছি, যাঁর কথা মনে করতে আমাদের এতটুকু কষ্ট পেতে হয় এবং আমরা হই অশ্রুসিক্ত, বেদনায় ব্যথিত। আজ থেকে ২৬ বছর আগে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাংলার চলচ্চিত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং জননন্দিত নায়ক সালমান শাহ এ দেশের লাখো ভক্তকে কাঁদিয়ে এবং দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নেন। সালমানের মৃত্যুটা এ দেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য কষ্টের।

এ দেশের কোটি কোটি সালমান–ভক্তের মধ্যে একজন অতিসাধারণ ভক্ত হয়ে আমি বিশ্বাস করি, সালমানের এমন করুণ মৃত্যু কোনো অবস্থাতেই কাম্য যেমন নয়, তেমনি আমাদের সবার প্রশ্ন, সত্যি কি এটা অপমৃত্যু বা আত্মহত্যা? যে সালমান এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে মাত্র তিনটি বছরে (১৯৯৩-১৯৯৬) এত কিছু দিয়ে গেছেন এবং বেঁচে থাকলে আরও অনেক কিছু দিতে পারতেন। সে সালমানের মৃত্যুটা আমার মনেও অত্যন্ত ব্যথার প্রবাহ এঁকেছিল যখন আমি মাত্রই কলেজের আঙিনায় প্রবেশ করি। আর ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬ যখন প্রথম বিটিভির সংবাদে সালমানের মৃত্যুর কথা শুনি। সত্যি বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হয়েছিল এবং আমার এ মন বিটিভির এমন সংবাদকে একটুও মেনে নিতে পারেনি!

আমার সেদিনের বন্ধুদের আজ কেউ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষক, কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ উপসচিব, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং ইউএনও; কেউ ব্যাংকিং সেক্টরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা; কেউ স্বনামধন্য ব্যবসায়ী এবং কেউ সম্মানীত রেমিট্যান্স যোদ্ধা। হয়তো আজ নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আমরা অধিষ্ঠিত, সমাজ এবং দেশের সেবায় একেকজন দায়বদ্ধ নাগরিক। তবে আমাদের জীবনের আদর্শিক মানদণ্ডে এবং জীবনাদর্শে মহানায়ক সালমান শাহর আদর্শ এবং অনুপ্রেরণা বেঁচে থাকবে আবহমান কাল। গানের সুরে মহানায়ক অভিনয় ছন্দে গেয়েছিলেন, ‘বাবা বলে ছেলে নাম করবে।’ আমার বিশ্বাস, আমার সেদিনের বন্ধুদের প্রত্যেকের মন এবং মননে আগামীকে জয় করার প্রত্যয়ে এ গানের কথা গেঁথে রয়ে গেছে একাকার হয়ে, যে গানের কথা, সে শক্তি আজও আমরা অনুভব করি আমাদেরœপ্রেরণায় এবং আমাদের মানসিক দৃঢ়তায়।

পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিক লিখেছেন, ‘আপনার কোটি কোটি ভক্ত এখনো আপনাকে আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখে। আপনি কি সেই চিঠিগুলো পড়েন? আপনি কি জানতে পারেন, এখনো তাঁরা আপনাকে কতটা ভালোবাসে? যেখানেই থাকেন, ভালো থাকেন, অসংখ্য মানুষের প্রিয় নায়ক সালমান শাহ। অতল শ্রদ্ধা এবং অফুরন্ত ভালোবাসা।’
ছবি: সংগৃহীত

আজ ২২ বছর ধরে সিলেটে আছি, আমার জীবনের যতটুকু সময় অতিবাহিত হয়েছে, তার অর্ধেকের বেশি সময় সিলেটের মাটি এবং আলো-বাতাসের সংস্পর্শে এ সিটিতে আমার বেড়ে ওঠা। নিজের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা থেকে ১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থী হিসেবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০০ সালের মে মাসে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। এরপর সুযোগ পেয়ে ভর্তি হই সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। সে থেকে এ শহরে আজ ২২টি বছর আমার পথচলা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং মাস্টার ডিগ্রি সম্পন্ন করে পেশাগত জীবনে প্রবেশ এবং আবারও নিজের প্রিয় বিভাগ সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতার পেশায় নিজেকে নিযুক্ত করা। আমাদের প্রিয় এ শহরে যেন অনেক কিছুই আছে, কিন্তু কি যেন নেই। আমাদের সবার প্রিয় মহানায়ক সালমান নেই।

প্রিয় পাঠক, বিশ্বাস করুন আপনারা, এ শহরের একেকটি রাস্তা দিয়ে চলতে, দাঁড়িয়া পাড়ার ‘সালমান শাহ’ ভবনের পাশ দিয়ে চলতে এবং আমাদের প্রিয় মহানায়কের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে কত শত-হাজার ফোঁটা চোখের পানি আমি ফেলেছি তার হিসাব হয়তো আমার কাছেও নেই। আমার এ লেখাটি লিখতে যতটুকু সময় বাসায় আমার কম্পিউটারে কি-বোর্ডে ব্যয় হয়েছিল, আমি ঠিক ততটুকু সময় কেঁদেছি, আর শুধু মনের কষ্ট সেই ব্যথাটাকেই বারবার টান দিয়েছিল—আজ যদি আমাদের মহানায়ক সালমান ভাইয়া বেঁচে থাকতেন! আজ আবার যদি ফিরে আসতেন আমাদের মহানায়ক!

সালমান শাহ
সংগৃহীত

আজ ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২। আজ যদি সালমান বেঁচে থাকতেন, তাহলে ৫৩ বছরে পা রাখতেন। মহানায়ক যদি আবার ফিরে আসতেন, তবে এ দেশের চলচ্চিত্র আবারও জেগে উঠত পুরোনো উদ্যমে; চলচ্চিত্রের সুনাম, মর্যাদা, শিল্প, ঐতিহ্য এবং সৌন্দর্য আবারও ফিরে আসত আরও একটিবার এবং এফডিসিতে মানুষের পদচারণ ও কর্মব্যস্ততায় অনেক বেশি মুখর থাকত প্রত্যেকটি শিল্পীসত্তা। আরেফিন শুভ, নিরব, সাকিব খান ও বাপ্পীর মতো বর্তমান প্রজন্মের নায়কেরা মহানায়ক সালমানের সংস্পর্শে আমাদের চলচ্চিত্রের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে সমর্থ হতেন আরও অনেক দূর। আসলে আমরা ব্যর্থ যে আমরা আমাদের মহানায়ককে খুব বেশি দিন ধরে রাখতে পারিনি এবং মহানায়কের কাজের মধ্য থেকে শিক্ষা অর্জনে খুবই বঞ্চিত হলাম, যিনি আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন মানবতা ও নৈতিকতা, যে মানবতা ও নৈতিকতার আজ আমাদের সমাজে এত অভাব!

মা নীলা চৌধুরী, আপনি আর সন্তানের জন্য চোখের পানি ফেলবেন না। আমরা বুঝি সন্তান হারানোর বেদনা কতটা ভয়াবহ আর তা আপনি প্রতিটা মুহূর্ত চরম যন্ত্রণায় অনুভব করছেন। আপনার সন্তান তো এ দেশের কোটি কোটি মায়ের সন্তানের মহানায়ক। মা, আমরাও তো আপনার সন্তানকে, আমাদের প্রিয় নায়ককে এতটুকু ভালোবাসি। কত দিন আপনার ইমনের (সালমান) অভিনয় দেখে এতটুকু কষ্ট পেয়েছি, কত দিন কেঁদেছি এবং এখনো খুব কাঁদি। আজও আমরা এতটুকু ব্যথা অনুভব করি এ ভেবে—আমাদের মহানায়ক সালমান শাহ যে ২৬টি বছর আমাদের মাঝে নেই। মা, এ দেশের কোটি কোটি সালমানভক্ত রয়েছে আপনার পাশে, যারা আপনার সন্তানকে প্রতিটি ক্ষণে স্মরণ করছে এক রাশ ব্যথা নিয়ে এবং যারা আপনার ব্যথার সব সময়ের সঙ্গী হয়ে প্রতিটি ক্ষণে প্রতিক্ষায় আছে—একদিন সত্যি সালমানের মৃত্যুর প্রকৃত সত্যটা বের হয়ে আসবে, কারণ আপনার সন্তান আমাদের শিখিয়ে গেছেন সত্যের মৃত্যু নেই।

লেখক: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট