ঠেলাওয়ালার সহযোগী: ২৫ বছর আগে ও পরে
রুখো রুখো। পেছন থেকে বারকয়েক বলতেই চালক আমাদের বহনকারী পর্যটন বাসটি থামালেন। নেমেই রাস্তার উল্টো দিকে চলে গেলাম। আমার সহযাত্রী বিদেশি সহপাঠী বন্ধুরা কিছুটা কৌতূহল এবং কিছুটা বিরক্তি নিয়ে দেখছে আমার কর্মকাণ্ড। তাদের মধ্যে দুজন ইন্দোনেশিয়ার, দুজন তানজানিয়ার, মিসরের একজন, আফগানিস্তানের দুজন ও শ্রীলঙ্কার দুজন।
মালামালবোঝাই ঠেলাগাড়িটি ঢালু রাস্তা পেরিয়ে ওপরে টেনে তুলতে ঠেলাওয়ালাকে সাহায্য করতে শুরু করলাম আমি। বৃদ্ধ ঠেলাওয়ালা একা অনেক চেষ্টা করেও গাড়িটি তুলতে পারছেন না। শারীরিকভাবেই আমি যে অনেক শক্তিশালী তা নয়; তাই আমি ও ঠেলাওয়ালা মিলেও গাড়িটি উঁচুতে ওঠাতে পারছি না। প্রচণ্ড খরতাপের দুপুর, রাস্তা প্রায় জনমানব শূন্য। সাহায্য করার মতো অন্য কোনো মানুষ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। হঠাৎ দেখলাম, বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে ঠেলাগাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে মিসরের বন্ধু খালেদ ও শ্রীলঙ্কার আজাঙ্কা। চারজনে মিলে ঠেলাগাড়িটিকে টেনে ঢালু পেরিয়ে রাস্তার ওপরে তুলে আনলাম। ঠেলাওয়ালার তামাটে বর্ণের ধনুকের মতো বাঁকা শরীরটা আস্তে আস্তে সোজা হতে শুরু করল। তার মুখে দেখা গেল কৃতজ্ঞতা ও স্বস্তিবোধের স্মিত হাসি। তিনি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ করজোড়ে আমাদের বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। খালেদ ও আজাঙ্কাকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বাসে উঠলাম। বাস চলতে শুরু করল, আমাদের গন্তব্য গান্ধী আশ্রম।
রাস্তায় প্রায়ই দেখা যায়, মালামালবোঝাই কোনো ঠেলা বা ভ্যান কোনো উঁচু রাস্তা বা ঢালে ওঠাতে অথবা কোনো গর্তে পড়ে যাওয়া চাকা টেনে তুলতে কোনো বয়স্ক ব্যক্তি প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন। এ ধরনের বিপদে পড়া মানুষদের সাহায্য করার কাজটা শুরু করেছিলাম একটি মর্মপীড়া থেকে। আমাকে এ কাজ করতে দেখে পরিচিত অনেকেই উৎসাহিত হয়েছেন।
শুরুতে বর্ণিত ঘটনাটি ছিল ভারতের গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদে ২০১৭ সালে। ভারত সরকারের আইটিইসি প্রোগ্রামের আওতায় ৪৫ দিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করছিলাম। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৩২টি দেশের ৭০ জন পেশাজীবীর অংশগ্রহণে ৩টি কোর্স চলছিল। প্রশিক্ষণের ফাঁকে একদিন কয়েকজন যাচ্ছিলাম গান্ধী আশ্রম পরিদর্শনে। গান্ধী আশ্রমে যাওয়ার পথে ঘটনাটি ঘটে। ঠেলাওয়ালাকে সাহায্য করে বাসে ওঠার পর আমার সহপাঠী বিদেশি বন্ধুরা ঠেলাওয়ালাকে সাহায্য করতে গেলাম কেন—জানতে চাইল। যে মর্মপীড়া থেকে এ কাজ করার চেষ্টা করি সেটি তাদের বললাম। ওই দিন সন্ধ্যায় ডিনারের সময় বিদেশি বন্ধুরা আড়াই দশক আগের মূল ঘটনাটা বলার জন্য অনুরোধ করল।
ঘটনাটা ১৯৯১ সালের। আমি তখন খুলনায় সরকারি ব্রজলাল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছি। কুয়েট ক্যাম্পাসের পাশে মহেশ্বরপাশায় শামসু কাকার বাড়ি। গ্রীষ্মের কোনো এক দুপুরে শামসু কাকা হঠাৎ ইন্তেকাল করেন। মৃত্যু সংবাদে আব্বা-মায়ের সঙ্গে আমরা চার ভাই-বোনও যাই শামসু কাকাদের বাড়িতে। দৌলতপুর, খালিশপুর ও খুলনা শহরের বিভিন্ন এলাকায় আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন থাকেন। সব বাড়িতে মৃত্যু সংবাদ পৌঁছাতে হবে। সব আত্মীয়ের বাড়িতে ফোন ছিল না। বেশির ভাগ বাড়িতেই সরাসরি গিয়ে সংবাদ পৌঁছাতে হবে। আমার বাইসাইকেল আছে, তাই খালিশপুর এলাকার আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে সংবাদ পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। সাইকেল চালিয়ে খালিশপুর এলাকা ঘুরে ১৪-১৫টি বাড়িতে সংবাদ পৌঁছাতে হবে। আমি চায়না ফিনিক্স সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
তখন মধ্যদুপুর। চারদিকে গনগনে কাঠফাটা রোদ। আমি খালিশপুরে হাউজিং টি-লাইনে শাহজাহান কাকার বাড়িতে সংবাদ পৌঁছে মুহসীন কলেজের পেছনের রাস্তা দিয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে ছুটে চলেছি; তখনো তিন-চারটি বাড়িতে মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানোর বাকি। শামসু কাকার মৃত্যুশোক বুকে নিয়ে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপে প্রায় দেড় ঘণ্টা একটানা সাইকেল চালিয়ে আমি ভীষণ ক্লান্ত, অবসন্ন। মুহসীন কলেজের পেছনের রাস্তা তখন প্রায় জনমানবশূন্য। হঠাৎ দেখি সামনেই একজন বয়স্ক ঠেলাওয়ালা জ্বালানি কাঠবোঝাই তাঁর ঠেলাগাড়ি টেনে ঢালু রাস্তার ওপরে ওঠানোর চেষ্টা করছেন। জীর্ণশীর্ণ বয়স্ক ঠেলাওয়ালার শরীর ঘামে গোসল হয়ে গেছে। তিনি একা বারবার চেষ্টা করেও ঠেলাগাড়িটি ওপরে তুলতে পারছেন না। সাহায্য করার মতো কেউ নেই কোথাও। আমাকে দেখেই লোকটা সাইকেল থামাতে এবং তাঁকে সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন। আমার শোকগ্রস্ত মন, ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর, আরও তিন-চারটি বাড়িতে মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানো এবং জানাজার আগে ফেরার তাড়া; এ পরিস্থিতিতে আমি সেই বৃদ্ধ ঠেলাওয়ালার অনুরোধ উপেক্ষা করে সাইকেল চালিয়ে চলে যাই।
সমস্যাটি হলো ঠিক এক সপ্তাহ পরে; যখন আমি বন্ধুদের সঙ্গে খালিশপুরের মুহসীন কলেজের পেছনের সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। ঠেলাগাড়ি আটকে পড়া রাস্তার ওই জায়গায় গেলেই আমার সেই বৃদ্ধ লোকটির কথা মনে পড়ে। আহ্, লোকটা কি শেষ পর্যন্ত কাউকে পেয়েছিল সহায়তার জন্য, ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে আরও কতটা সময় তাঁকে সেই খরতাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল, আমি যদি কয়েক মিনিট সময় ব্যয় করে তাঁকে একটু সাহায্য করতাম, তাতে কী এমন ক্ষতি হতো—এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন বিবেককে দংশন করতে থাকে। এক তীব্র মর্মপীড়া অনুভব করতে থাকি আমি। কয়েক দিন পর খালিশপুরের আরেকটি রাস্তায় একইভাবে যখন একটি ছেলেকে দেখি, গর্তে আটকে যাওয়া তার ভ্যানগাড়ির চাকা টেনে তোলার চেষ্টা করছে, তখন আমি বন্ধু লিটনকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাই, সেই বাচ্চা ছেলেটিকে সাহায্য করতে। এর পর থেকে চোখে পড়লেই এ ধরনের অসহায় ভ্যানওয়ালা, ঠেলাওয়ালাদের সাহায্য করা আমার নিয়মিত কাজ, অন্তত সুযোগ থাকলে চেষ্টা করি; যা এখন অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
বিস্তারিত ঘটনা শুনে গুজরাটে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির আমার সেই সহপাঠী বিদেশি বন্ধুরা খুবই উদ্দীপ্ত হয়। সকালে গাড়ি থামানোর জন্য কিছু বিরক্তিবোধ করায় তারা দুঃখ প্রকাশ করল। নিজ নিজ দেশে এ ধরনের অসহায় কাউকে দেখলে সাহায্য করতে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞাও করল তারা।
*লেখক: মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন শেখ: সহকারী মহাব্যবস্থাপক (যোগাযোগ ও প্রকাশনা), পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]