বিশ্ব শিক্ষক দিবস ও আমার শিক্ষক হয়ে ওঠার আনন্দ

বিশ্ব শিক্ষক দিবস
অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল

আমি কোনো দিন শিক্ষক হতে চাইনি। তবে আমি যা যা হতে চেয়েছিলাম, তা একজন শিক্ষক হলেই কেবল হওয়া সম্ভব ছিল। হতে চেয়েছি একজন মানবিক মানুষ। সত্য, সুন্দর, ন্যায়ের কথা বলব। একজন বিচারক, যার চোখ সব বৈষম্য দূর করে নিশ্চিত করবেন সমতা। ডাক্তার কিংবা সেবিকা, যিনি পরম মমতা বুকে নিয়ে পাশে থাকবেন, যত্ন করবেন রোগীর। মোটিভেশনাল স্পিকার, অন্যকে পথ বেছে নিতে সাহায্য করবেন। লেখক—মুগ্ধতায় বেঁধে রাখবেন পাঠকদের। সংবাদ পাঠক, যার কথা বলা হবে অনুকরণীয়। অথচ এতগুলো পেশা একসঙ্গে বেছে নেওয়া একজনের পক্ষে অসম্ভব।

তবে যদি আমি শিক্ষকতাকে বেছে নিই, তখনই কেবল সব কটি পেশা ধারণ করা সম্ভব। তাই এইটুকু জীবনে পূর্বাপর না ভেবে বেছে নিয়েছি পরিবারের অধিকাংশ প্রিয়জনকে এই মহান ব্রত।

একটু বোধ হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি পরিবারে যাঁরা এই পেশায় আছেন, তাঁরা পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করছেন কতটা নিবিড়ভাবে, ঠিক যেন প্রার্থনার মতো। কতটা সম্মান আর শ্রদ্ধা নিয়ে তাঁরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, শরীর ও মনে প্রশান্তি।

আমার বাবা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। স্কুলের দপ্তরি কিংবা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর আগে তিনি বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতেন। নিজেই নিজের কক্ষ পরিষ্কার করতেন। প্রয়োজনে ঝাড়ু দিতেন। সহকর্মী থেকে শুরু করে অভিভাবকদের সঙ্গে তাঁর আচরণ ছিল অনুসরণ করার মতো। বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সংস্কারের জন্য আসা সরকারি টাকা কাজ শেষে অবশিষ্ট থাকলে তা ফেরত দিয়েছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন কালকিনি থানার সব শিক্ষকের রোল মডেল। হয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।

ঈদ কিংবা পূজার ছুটিতে আমাদের বাড়িতে যখন আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসতেন, প্রতিবেশীরা ভীষণ খুশি হতেন। খালা, খালু, খালাতো ভাইবোন, বাবা, নিজের ভাইবোনেরা সবাই তো শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছেন জীবন ও ভালোবাসার জন্য। খুব ভোরে ছোট ছোট বাচ্চারা চটের বস্তা, হোগলা পাতার পাটি, পিঁড়ি, যাদের কিছুই ছিল না বসার, তারা মাটিতে বসে পড়ত। যার যে বিষয়ে সমস্যা ছিল সে বিষয়ের সমাধান নিত। এভাবেই চলতে থাকত দেড় দুই সপ্তাহের এই আয়োজন। সন্ধ্যা হলে উঠানে মাদুর পেতে মা, খালা, বোনেরা বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করতেন। কোন পদ্ধতিতে পড়ালে সহজগম্য ও পাঠ হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়। গণিতের বিভিন্ন নিয়ম, ইংরেজির কোনো সংশোধনী কিংবা বিজ্ঞানের সূত্র নিজেরাই যেন আরও একবার ঝালাই করে ছুটি কাটিয়ে তাঁরা শহরে ফিরতেন। অতঃপর আমাদের আবার অপেক্ষা তাঁদের ফেরার...

প্রায়ই বলি, শিক্ষক তো ছিলেন সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, প্লেটো কিংবা...এঁরা। আমি তো শুধু শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করি। আমি তো দেখি পর্যাপ্ত আলোয় ভরেছে কি দেবালয়? কেউ কি হঠাৎ অসুস্থ বোধ করছে? তাদের জানার শেষ ট্রেন কি আদৌ ছেড়ে যাবে প্ল্যাটফর্ম? আমি তো শুধু ওদের চকচকে চোখ দেখি, শৈশব দেখি, যার স্থায়িত্ব জীবনে খুব কম; তারুণ্য দেখি, যা আমার বিগত হয়েছে। উচ্ছ্বাস দেখি, জীবন দেখি, সারল্য দেখি, কৌতূহল দেখি, এগুলো দেখতেই তো প্রতিদিন আসি। আমি তো শুধু ওদের আমার মতো করে ভালোবাসি, ভালো না বেসে পারি না বলে। আমি তো ওদের মাঝে আমাকে দেখি, ফেলে আসা ক্লাসরুম, বিস্তৃত মাঠ, প্রিয় শিক্ষকের ডাক শুনতে পাই। তাই শিক্ষার্থীদের বন্ধু হতে গিয়ে হয়ে উঠি পরিবারের একজন।

আজ ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। গর্ভধারিণী মা থেকে প্রকৃতি মা—সবাই আমার শিক্ষক। আমার সন্তানসম শিক্ষার্থীরা আমার শিক্ষক, ওরা জানে না আমি কতটা সমৃদ্ধ হই ওদের কাছ থেকে।