পাহাড়ের দেশে খুদে নৃবিজ্ঞানীদের কাটানো দিনগুলো

ছবি: লেখক

ভ্রমণ মানুষকে কূপমণ্ডূকতার ছত্রচ্ছায়া থেকে মুক্ত করে বিশাল পৃথিবীর অপার সৌন্দর্যের মধ্যে ঠাঁই দেয়। মানুষের মনকে করে তোলে উদার। আর সেই ভ্রমণ যদি হয় শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে, তাহলে তো কথাই নেই। ঠিক এমন একটি শিক্ষাসফরে আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ১০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করি। আমাদের এবারের মিশন ‘মেঘপাহাড়ের রাজ্য’। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানের আলোচিত পর্যটনকেন্দ্র, সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পাহাড়িদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন দেখাই ছিল আমাদের এবারের লক্ষ্য। আমাদের শিক্ষাসফরে দিকনির্দেশক হিসেবে ছিলেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. লিটন হোসেন এবং প্রভাষক এস এম সানজিদ রহমান স্যার।

আমরা ভ্রমণের শুরু থেকেই খুবই কৌতূহলী ছিলাম। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড় ভ্রমণে রয়েছে সত্যিকারের অ্যাডভেঞ্চার। রয়েছে জীবনের ঝুঁকিও। একই সঙ্গে পাহাড়ের বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য মানবমনকে করে তোলে তারুণ্যদীপ্ত। তাই পাহাড়ের অপার্থিব সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি বলেছেন, ‘এসো বন্ধু, দেখে যাও, সেই স্বর্গভূমি। পাহাড় ছুঁয়েছে আকাশ এখানে, আকাশ ছুঁয়েছে ভূমি।’

দিনটি ছিল মঙ্গলবার। ভোরের সূর্যের দেখা এখনো মেলেনি। কুয়াশাজড়ানো সেই কনকনে শীতের সকালে আমরা বেরিয়ে যাই। সকাল ৭টায় ট্রেনযোগে রাজশাহী থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হই। এরপর চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ির পথে আঁকাবাঁকা, উঁচু–নিচু পথ এবং রাস্তার দুধারে ঘন বনজঙ্গল অনুভূতিতে নাড়া দেয় যে আমরা ভ্রমণে এসেছি। ভ্রমণক্লান্তি দূর হয়ে সবার মুখে যেন আনন্দের ছিটেফোঁটা দেখা দেয়। খাগড়াছড়ি থেকে আমরা চাঁদের গাড়িতে করে ফের রওনা শুরু করি। আমাদের ভ্রমণের প্রথম কেন্দ্র হলো আলুটিলা গুহা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় আলুটিলা পাহাড়ে শীতল এই গুহাটি অবস্থিত। স্থানীয়রা এই গুহাকে দেবতার গুহাও বলে থাকেন। আমরা সবাই মুঠোফোনের লাইট জ্বালিয়ে সারিবদ্ধভাবে গুহাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিদর্শন করি। গুহা থেকে বেরিয়ে এবার আমরা মেঘপাহাড়ের রাজ্যখ্যাত সাজেকের উদ্দেশে রওনা শুরু করি।

ছবি: লেখক

সংখ্যায় আমরা ২৫ জন, দুটো চাঁদের গাড়িতে চেপে এগোতে থাকি। আঁকাবাঁকা রাস্তা, দুধারে ঘন বনজঙ্গল, সরু রাস্তা কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। এভাবে চাঁদের গাড়িতে সাজেকে পৌঁছালাম বিকেল ৫টায়। এখানে এসে বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। প্রায় দুই হাজার ফুট পাহাড়ের ওপর ঝকমকে প্রশস্ত পথ। শহরের আদলে তৈরি ফুটপাত একেবারে পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি। পথের পাশে পাহাড়িদের বাড়িঘর নান্দনিকভাবে সাজানো। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বেশ কিছু কটেজ প্রস্তুত, যেখানে অল্প খরচেই রাতযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা থাকার জন্য কাসালং গেস্টহাউস ঠিক করি। একটুখানি ফ্রেশ হয়েই আমরা চলে গেলাম হ্যালিপ্যাডে, যেখানে সবাই মিলে সূর্যাস্ত উপভোগ করি। কাকতালীয়ভাবে সেই রাতেই সহপাঠী জাকিয়া সুলতানার জন্মদিন ছিল। সেই রাতে সাজেকে কেক কেটে জন্মদিন উদ্‌যাপন করে দিনটি স্মরণীয় করে রাখি। এরপর আমরা বিশ্রামে চলে যাই।

পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়লাম কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশে। কংলাক পাহাড়ে হেঁটে ওঠা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। আমরা শীতকালে ভ্রমণ করায় সাজেকের প্রধান আকর্ষণ ভাসমান মেঘপুঞ্জের দেখা পাইনি, তবে সেখানে কুয়াশাজড়ানো সকাল আর হিম হিম বাতাসে বাঁশের পাত্রে চা অন্য রকম অনুভূতির সঞ্চার করেছে।

পরদিন সকালে সাজেক ছেড়ে রওনা হলাম বান্দরবানের উদ্দেশে। প্রথমে চাঁদের গাড়ি এবং পরে বাসযোগে রাত আটটায় বান্দরবান শহরে পৌঁছলাম। সেখানে টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের রোয়াংছড়ি উপজেলা প্রকল্প ব্যবস্থাপক থুইচা চিং মারমা দাদা খুব স্বল্পমূল্যে থাকা এবং খাওয়ার বন্দোবস্ত করলেন।

ছবি: লেখক

পরদিন সকালে রামজাদি মন্দির, স্বর্ণমন্দির এবং গোল্ডেন ট্যাম্পল দর্শন করলাম। এরপর প্রকৃতির টানে চলে গেলাম বান্দরবানের পর্যটন কমপ্লেক্স মেঘলায়, এরপর আবার চাঁদের গাড়িতে চেপে চলে গেলাম মেঘেদের দেশ নীলাচলে। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে টাইগারপাড়ার পাহাড়চূড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে আকর্ষণীয় এ পর্যটনকেন্দ্র। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ৬০০ ফুট উঁচু এ জায়গায় চমৎকারভাবে পাহাড়ের ঢাল থরে থরে সাজানো হয়েছে। প্রতিটি জায়গা থেকে সামনের পাহাড়ের দৃশ্যও ভিন্ন রকম। শুনেছি বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত—তিন ঋতুতে ছোঁয়া যায় মেঘ। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এসেছিলাম শীতে।

এবার রওনা করলাম বাংলাদেশের পাহাড়ি সৌন্দর্যের রানি হিসেবে পরিচিত এবং দেশের তৃতীয় বৃহত্তম চিম্বুক পাহাড়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ পাহাড়ের উচ্চতা ২ হাজার ৬০০ ফুট। পাহাড়ের প্রবেশপথ ধরে একটি লম্বা-সরু রাস্তা দিয়ে আমরা চূড়ায় উঠলাম। লম্বা একটি বিকেল সেখানে কাটানোর সুযোগ হলো। চমৎকার এ মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দী করতে চিম্বুক পাহাড়ের চূড়ায় আমরা গ্রুপ ফটো তুললাম। এরপর ছুটে চললাম বাংলাদেশের দার্জিলিংখ্যাত নীলগিরির পথে। দিগন্তজুড়ে বিস্তীর্ণ সবুজ পাহাড়, এর মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘেদের দল। মেঘপাহাড়ের দেশে এসে এবার মেঘের দেখা পেয়ে আমাদের ভ্রমণ যেন পূর্ণতা পেল। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবশেষে আমরা নীলগিরিতে পৌঁছালাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতায় নীলগিরি সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। প্রকৃতি এখানে বৈচিত্র্যময়। ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদলায়। তীব্র ঠান্ডার বিপরীতে নীলগিরির চূড়ায় সূর্যাস্ত দেখার মুহূর্তটা ছিল অসাধারণ।

ছবি: লেখক

একটি ভ্রমণময় ব্যস্ততম দিন পার করে এবার গন্তব্য থানচি। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চাঁদের গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে পাহাড় থেকে নামছে। আঁকাবাঁকা ভয়ংকর রাস্তাগুলো চালকেরা খুব সতর্কতার সঙ্গে অতিক্রম করছেন। পথে অতিরিক্ত নিরাপত্তার স্বার্থে দুবার বিজিবি ক্যাম্পে আমাদের থামতে হয়েছিল। শুধু তা–ই নয়, বান্দরবান এমন একটি জায়গা যেখানে প্রতি পদে পদে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছিল। তবে আমাদের সঙ্গে লিটন হোসেন স্যার থাকায় তিনি জটিলতাগুলো তাঁর চতুরতা দিয়ে নিমেষেই সমাধান করেছিলেন। যাহোক, প্রায় দুই ঘণ্টা বিরতিহীন চলার পর আমরা থানচিতে পৌঁছাই। থানচিতে আমরা একটি কাঠের রিসোর্টে ছিলাম।

থানচিতে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) বান্দরবান শিশু শিক্ষা অধিকার প্রকল্পের সাবেক আঞ্চলিক সমন্বয়কারী কো কো চিং দাদা আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। সেখানে পৌঁছানোর পর পাহাড়িদের আইন, নিয়মনীতি, জীবনব্যবস্থা ও অধিকার সম্পর্কে ঘণ্টাখানেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন। আমাদের ‘অ্যানথ্রোপলজি অব হিউম্যান রাইটস’ কোর্সের শিক্ষক মো. লিটন হোসেন স্যার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করেন। যেহেতু এটি শিক্ষাসফর, তাই ভ্রমণ শেষে এসব আলোচনা এবং আমাদের ট্যুরের অভিজ্ঞতার আলোকে একটি অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিটের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

পরদিন সকালে আমরা প্রতি নৌকায় পাঁচজন করে পাঁচটি নৌকা নিয়ে থানচি থেকে রেমাক্রির উদ্দেশে রওনা হই। দুই ধারে উঁচু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী, কিছুক্ষণ পরপর পাহাড়ের উপত্যকায় দেখা মেলে কিছু মানুষের বসবাসের চিত্র। ভ্রমণকালে পদ্মমুখ, ভূস্বর্গখ্যাত, রাজাপাথর, বড়পাথর এলাকা এবং রেমাক্রি ফসলের সৌন্দর্য ভোলার মতো নয়। বার্মিজ নৌকায় চেপে সাঙ্গু নদের স্রোতের প্রতিকূলে প্রায় তিন ঘণ্টা যাওয়ার পর আমরা কাঙ্ক্ষিত সেই রেমাক্রিতে পৌঁছাই।

ছবি: লেখক

রেমাক্রিতে আমরা শিলগিরি রিসোর্টে উঠি। পুরো বিকেল আমরা রেমাক্রির আশপাশের গ্রামগুলো ঘুরে দেখি। এরপর সাঙ্গু নদে সৃষ্ট ছোট জলপ্রপাতের স্বচ্ছ পানিতে আমরা সকলে গোসল করি। রাতে বহুল আলোচিত সেই বনমোরগ দিয়ে রাতের খাবার সেরে নেই। আমাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা থার্টি ফার্স্ট নাইট রেমাক্রিতেই উদ্‌যাপন করি। বন্ধুসুলভ শিক্ষকবৃন্দ ও সহপাঠীদের সঙ্গে সেই রাতের হইহুল্লোড় কখনো ভোলার নয়। থার্টি ফার্স্ট নাইটে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আমাদের সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত।

পরদিন কাকডাকা ভোরে আমরা রেমাক্রি থেকে নাফাকুমের উদ্দেশে রওনা করি। যাত্রাটি খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না। কনকনে শীতে টানা আড়াই ঘণ্টা উঁচু–নিচু পথ কখনো পাহাড়, কখনো নদী, কখনো কাদাময় দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। দুজন গাইড আমাদের যাত্রার সঙ্গী হয়েছিলেন। একজন ওসা মো মারমা এবং মং আই। অত্যন্ত সুচারুভাবে তাঁরা আমাদের নিজ এলাকার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এভাবে দীর্ঘ পথ হেঁটে পাড়ি দিয়ে আমরা নাফাকুমে পৌঁছাই। পানিপ্রবাহের দিক থেকে নাফাখুমকেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত বলে অনেকে মনে করেন। অনেকে আবার এটিকে বাংলাদেশের নায়াগ্রাও বলে থাকেন।

ছবি: লেখক

আমরা নাফাকুমে নিজেদের মতো করে ছবি তুললাম। দুই ঘণ্টা নাফাকুমে অবস্থান করে আমরা আবার রেমাক্রির হয়ে সন্ধ্যায় থানচিতে পৌঁছালাম। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা থানচিতে একটি বারবিকিউ পার্টি করলাম। পাহাড়ে শীতের রাতে বারবিকিউ পার্টিতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার বিষয়টি স্মৃতির পাতায় যেন নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।

মেঘ, পাহাড়, নদী ঘোরাঘুরি শেষে এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে মেঘবাতি রিসোর্টকে বিদায় জানিয়ে আমরা চাঁদের গাড়িতে করে তিন পর্বতশৃঙ্গের মিলনস্থল তমাতুঙ্গী পাহাড় ভ্রমণ করি। যেখান থেকে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ তাজিংডং, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কেওক্রাডং পর্বতশৃঙ্গ এবং ডিম পাহাড়ের দেখা মেলে। শিক্ষাসফরের এই সাতটি দিন শিক্ষক ও সহপাঠী-বন্ধুদের সঙ্গে নতুন করে সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে। নতুন করে চিনেছি, জেনেছি। স্মৃতির ডায়েরিতে যুক্ত হলো আরও একটি অধ্যায়।

লেখক, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়