দক্ষিণ এশিয়ার সমাজব্যবস্থা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের সমন্বয়ে আঞ্চলিকভাবে পরিবেষ্টিত একটি মহাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি দেশের নিজস্ব দর্শন মতাদর্শ ও স্বাধীন সার্বভৌমত্ব অধিকার বিদ্যামান রয়েছে। সেই দর্শন, ভাবাদর্শ ওই দেশের মানুষের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ফুটে ওঠে, যা দেশগুলোর স্বতন্ত্র সত্তা বহন করে দেশীয় ও বৈশ্বিক মানচিত্রে।

দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক কাঠামোব্যবস্থা দেশগুলোর অর্থনীতিক সূচক, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং মানবাধিকার চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, খাদ্যাভাস, পেশা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি চিরায়ত অবস্থানের খুব বেশি পরিবর্তন নেই। যার দরুন এ দেশগুলোর সমাজ ব্যবস্থাপনা ও জীবনযাপনের ধরন প্রায় সমমানের। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পর্যায়ের সমাজব্যবস্থা সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তন হয়েছে দেশগুলোর সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সক্ষমতা ও ভিত্তি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে জড়িত।

করোনাপরবর্তী বিশ্ব এখন রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের খোলসে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ভৌগোলিকভাবে বিশ্বরাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতির গুরুত্ব অত্যধিক। বিশ্বরাজনীতির পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতেও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পরিলক্ষিত।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি–সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রভাবে জ্বালানি ও তেলের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে। এতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর বিদুৎ ও জ্বালানি ঘাটতি সৃষ্টির হয়েছে। এ ছাড়া নিত্যপণ্যের আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রম আগের তুলনায় সচল নয় বিধায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে।

যে কারণে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, সামাজিক সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা আগের সময়ের তুলনায় চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া বিশ্ববাজারে ডলারের দাম বাড়ার কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাচ্ছে। তাই প্রতিটি দেশ তাদের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য, সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে গত মে মাসে মুদ্রাস্ফীতিতে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জরুরি নয়, এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। পাকিস্তানে জুন মাসে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ২১ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মালদ্বীপে সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়তে দেখা গেছে। এ ঋণের পরিমাণ তাদের জিডিপির তুলনায় ১০০ শতাংশের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যান বলছে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে আছে মালদ্বীপ। মোদ্দা কথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা গুরুতর সময় পার করছে।

পুরো বিশ্বের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিতিশীল এ পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক উন্নয়ন সংস্থা সার্ককে ঢেলে সাজাতে হবে এবং কমিউনিটি এক্সচেঞ্জ নীতির মাধ্যমে প্রতিটি দেশে সার্কের কার্যক্রম গতিশীল করতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ নির্মাণ করে এ অঞ্চলে বেকারত্ব সমস্যা হ্রাস করতে হবে। প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ ও সীমান্তজনিত সমস্যা সমাধান করতে হবে। বিদেশ থেকে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সকৃত অর্থ আনয়নে নিয়মনীতি কিছুটা শিথিল করতে হবে।

আমদানি–রপ্তানির ব্যয় কমাতে উৎপাদনমুখী হয়ে পণ্য বৃদ্ধি করতে হবে। নিজেদের দেশের সীমাবদ্ধকৃত সম্পদের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। জ্বালানি সাশ্রয়ে অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা। তা ছাড়া প্রতিটি দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক খাতগুলোকে গবেষণানির্ভর করতে হবে। যাতে ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথরেখা রচিত হয় দেশগুলোতে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ঐক্য ও সম্প্রীতির ঝান্ডা রুপায়ন লাভ করবে বিশ্বব্যাপী। যার সুফল ভোগ করবে দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ জনগণ থেকে বিশ্ববাসী।

লেখক: শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান, শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়