আর্থিক খাতের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকপতন

ডলার
ছবি: সংগৃহীত

করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব শেষ হতে না হতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তাই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাবে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে।

এর উদ্দেশ্য হলো অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ হ্রাস করা। সে জন্য নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর আট ধাপে নীতি সুদহার বাড়ায়। এতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি। ফলে সিলিকন ভ্যালি (সিভি) ব্যাংক এবং সিগনেচার ব্যাংকের পতন ঘটে। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে দুটি ব্যাংকের পতন।

প্রযুক্তিনির্ভর ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অন্যতম সিভি ব্যাংক। বিনোদনমূলক কনটেন্ট ও ডেলিভারি সেবাদাতা হিসেবে প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপগুলো প্রচুর মুনাফা করে। বিপুল পরিমাণ মুনাফা করায় স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। ফলে তাদের বড় পুঁজির প্রয়োজন দেখা দেয়।

এ ক্ষেত্রে সিভি ব্যাংক প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ঋণের সিংহভাগ অর্থ ব্যাংকটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ করেছিল। এ খাতে বিনিয়োগের আস্থা তৈরি হওয়ায় ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণও বেড়ে গিয়েছিল।

অন্যদিকে করোনাকালে স্টার্টআপগুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে, যার নেতিবাচক প্রভাব প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর ওপর পড়ে। তাই প্রযুক্তি সংস্থাগুলো ঝুঁকিতে পড়ে। ঝুঁকিতে থাকা প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদেরও আগ্রহ কমে আসছিল। তাই বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি এড়াতে মার্কিন বন্ডে বিনিয়োগ বাড়াতে শুরু করে। বেশি সুদের কারণে প্রযুক্তি সংস্থার আইপিওর বাজার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর তহবিলসংকটে পড়ে।

তাই নগদ টাকার সংকট মেটাতে প্রযুক্তি সংস্থাগুলো সিভি ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা আমানত ভাঙতে শুরু করে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির এ সময়ে গ্রাহকদের চাহিদার কারণে অর্থের প্রয়োজন বাড়ে। ফলে ব্যাংকের আমানতে টান পড়ে। তাই ব্যাংকটি নগদ তহবিল জোগান দিতে সমস্যায় পড়ে।

বিনিয়োগকৃত মার্কিন বন্ডে সুদের হার কম থাকায় সিভি ব্যাংকটি বন্ড বিক্রি করে লোকসানে পতিত হয়। লোকসান পূরণ করার জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২০০ কোটি ডলার তোলার পরিকল্পনা করা হয়। সমস্যা উত্তরণের জন্য শেয়ার বিক্রি শুরু করে ব্যাংকটি। শেয়ারের দাম প্রায় ৬০ শতাংশ হ্রাস পায়। খবর ছড়িয়ে পড়ে, ব্যাংকটির যতটা অর্থ প্রয়োজন, ততটা জোগাড় করতে পারছে না। এরপর শেয়ার বিক্রিও বন্ধ হয়ে যায়।

ফলে ব্যাংকটির পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সিভি ব্যাংক বন্ধ হওয়ার কারণে ‘সিগনেচার ব্যাংক’, ‘ফাস্ট রিপাবলিক’, ‘প্যাকওয়েস্ট ব্যানকর্প’ শেয়ার বেচাকেনা স্থগিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করা হয়, যার প্রভাব বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যম সারির ব্যাংকগুলোর ওপর পড়েছে। আতঙ্ক এতই যে পরিস্থিতি সামাল দিতে ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন অনুরোধ করেছে, শুধু আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত নয়, সব প্রকার আমানতেই যেন পরবর্তী দুই বছর পর্যন্ত বিমা দেওয়া হয়।

সিভি ব্যাংক ও সিগনেচার ব্যাংক দুটি বন্ধ হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে তারল্যসংকট অন্যতম। ব্যাংক বন্ধ ঘোষণার প্রায় দুই দিন আগে ছড়িয়ে পড়ে, ব্যাংকটি গুরুতর আর্থিক ঘাটতিতে ভুগছে। ঘাটতির পরিমাণ এতটাই যে তাদের প্রয়োজন ২২৫ কোটি ডলার। ফলে ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যায়। দুদিন আগে থেকে হাজার হাজার গ্রাহক নিজেদের ব্যাংক হিসাব খালি করে সব টাকা তুলে নিয়ে যান। ব্যাংকটি বন্ধ ঘোষণার আগেও যেখানে মোট ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থ ছিল, সেখানে ব্যাংক রানের ফলে মাত্র ৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা অবশিষ্ট ছিল।

ব্রিটাানিকা ডটকমের তথ্যমতে, ১৭৭২ সালে লন্ডনে ব্যাংকগুলোতে তীব্র তারল্যসংকটের জন্য ব্যাংকে ধস নামে। এর প্রভাবে স্কটল্যান্ডের প্রায় প্রতিটি প্রাইভেট ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। ফলে ইউরোপের আর্থিক কেন্দ্র আমস্টারডাম থেকে হামবুর্গ, সেন্ট পিটার্সবার্গ, জেনেভা, স্টকহোম ও প্যারিস পর্যন্ত সংকটকে ঘনীভূত করে তোলে।

এ ছাড়া ১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকট ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। তখনো একই সময়ে আমানতকারীরা গণহারে তাদের সঞ্চিত অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নিতে শুরু করেছিলেন, ফলে ব্যাংকে তারল্য সমস্যার সৃষ্টি হয়ে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। লেম্যান ব্রাদার্সের কথা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। ২০০৮ সালে তারল্যসংকটের জন্যই ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে।

সিভি গ্রাহক মূলত ছিল প্রযুক্তিগত স্টার্টআপ কোম্পানি। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট খাতে সিংহভাগ বিনিয়োগ করত। ফলে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। নির্দিষ্ট খাত দুর্বল হয়ে পড়ায় ব্যাংকটির পতন হয়। ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের বাজারবিষয়ক উপ-অর্থনীতিবিদ জোনাস গোল্টারম্যানের মতে, ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক শুধু নির্দিষ্ট কিছু শিল্পে ঋণ দিত বলে সংকটে পড়েছে।’

তবে অর্থায়ন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলোর মুনাফার হার এবং ঝুঁকির মাত্রায় নাটকীয় প্রভাব ফেলেছে। মুদ্রার চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুর্বল হয়ে পড়ে। সে জন্য রয়টার্সের বিশ্লেষণে কিছু তথ্য উঠে এসেছে। সে তথ্যমতে, প্রথমেই ফেডারেল রিজার্ভের ক্রমবর্ধমান সুদের কথা বলা হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ধাপে ধাপে সুদের হার বাড়াতে থাকে। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চায়নি। সে জন্যই অপ্রত্যাশিত সমস্যা তৈরি হয়েছে।

এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ব্যাংকধসের অন্যতম কারণ, যা অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে। স্বল্পমেয়াদি আমানতকে দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়। ব্যাংকের যখন সুদহার বেড়েছে, তখন বন্ডের মূল্য কমেছে। সিভি ব্যাংক যে বিপুল পরিমাণ বন্ড কিনেছিল, তারল্যসংকট মেটাতে সেগুলো বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এতে ব্যাংকটির প্রচুর লোকসান হয়।

কারণ, উচ্চ সুদহার এবং বন্ডের দাম বিপরীতমুখী। বলা যেতে পারে, সুদহারের বিপরীতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে না পারায় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে ব্যাংক দুটিকে। সে ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণব্যবস্থা এবং আর্থিক খাতের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনাই মূলত দায়ী। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় আমানতের সংস্থান সম্ভব না হলে ব্যাংক একধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।

আবার ব্যাংকের পর্যাপ্ত তহবিলের চেয়ে দক্ষ তারল্য ব্যবস্থাপনা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ তারল্য ব্যবস্থাপনার অভাবেই অনেক সময় ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা থেকে অর্থনৈতিক সংকট গভীর থেকে গভীরতর হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সিভি ব্যাংক এবং সিগনেচার ব্যাংকের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে।

লেখক: অন্‌জন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট