আসুক না আমার ঠিকানায় রঙিন খামে তার লেখা চিঠি...

১৯৭৩ সালে নির্মিত হিন্দি চলচ্চিত্র ‘ব্লাকমেইল’–এ চিঠি পড়ছেন রাখী গুলজার
ছবি: সংগৃহীত

বন্ধুবান্ধব, ভাই–বোন, মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী তথা পরিবার, পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন—সবাইকে ঘিরেই আমাদের সমাজ, আমাদের বন্ধন। বাড়ি বসে মা জানতে চান, তাঁর সন্তান দূর প্রবাসে কিংবা দূরের ওই শহরে কেমন আছে। বাবা জানতে চান, সন্তানের কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো অচিন শহরে। অন্যদিকে সন্তানদেরও জানার বড় ইচ্ছা জাগে মা–বাবা কেমন আছেন গ্রামের বাড়িতে। ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ সময় যোগাযোগমাধ্যম অনেক সহজ হয়ে ওঠেছে। মুহূর্তেই বার্তা পাঠানো যাচ্ছে আপনজনের কাছে। শুধু মেসেজই নয়, অডিও–ভিডিও বার্তা কিংবা কথাও বলা যাচ্ছে। যোগাযোগ তো সহজেই করা

যাচ্ছে, তাহলে চিঠিপত্র লিখে ডাকবাক্সে ফেলে কেন দিনের পর দিন অপেক্ষা করা—এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। কিন্তু তাই বলে রঙিন খামে মনের মাধুরি মিশিয়ে লেখা চিঠিপত্রের আবেদন কি ফুরিয়ে যাবে। আমার তো মনে হয়, চিঠিপত্র লেখা কিংবা চিঠিপত্র পাওয়াটা আরও প্রিয় হয়ে ওঠেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি অনেক মন্তব্য পড়েছিলাম। অধিকাংশ মানুষই লিখেছেন, চিঠিপত্রের আবেদন কখনো ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। বরং এটির চর্চা বাড়ানোর কথা বলেছেন অনেকে। আবার অনেককে নিজের জমিয়ে রাখা চিঠিগুলোর ছবি ফেসবুকে শেয়ার করতে দেখা গেছে। আমিও আমার বন্ধুকে দুটি চিঠি লিখেছিলাম। যদিও অনলাইনে ওর সঙ্গে সব সময়ই কথা বলার সুযোগ রয়েছে। আমার চিঠিগুলো পেয়ে ওর মধ্যে যে ব্যাকুলতা দেখেছি, তা মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে হাজারো টেক্সট করে তা দেখতে পাইনি। ও বলল, ‘তোমার বন্ধু এমন চিঠি রোজ রোজই পেতে চায়।’ চিঠি লেখারও রয়েছে আলাদা একটি আনন্দ। অনেক সতর্ক ও যত্নে লেখা একটি চিঠি হয়ে ওঠে বন্ধুর প্রিয় ও স্বযত্নে স্মৃতির অ্যালবামে রেখে দেওয়ার বস্তু। আমরা বেখেয়ালিভাবে হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে যা খুশি লিখে দিয়ে কুশলাদি জানতে পারি। কিন্তু চিঠিপত্র লিখতে গিয়ে একজন মানুষ তাঁর মনের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে লেখেন। শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, সাজানো, খাম নির্বাচন—সব কিছুতেই থাকে আলাদা আয়োজন, ভিন্ন প্রয়াস। যেন প্রিয় মানুষটি খুশি হন চিঠি দেখেই।

চিঠির ডাকবাক্স এখন কদাচিৎ দেখা যায়। দেখা মেললেও এগুলোকে দিনের পর দিন খালিই পরে থাকতে দেখা যায়। কেউ আর আগের মতো চিঠি ফেলা না সেগুলোয়। অনেক জায়গায় বাক্সগুলোয় মরিচা ও ময়লার আস্তরণ পড়েছে। অর্থাৎ অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে রয়েছে সেগুলো। এগুলো যেন জাদুঘরে জায়গা করে নিয়েছে, তবে ব্যতিক্রম থাকতে পারে, সেটি নিতান্ত অল্পই মনে হচ্ছে। চিঠি লেখার ঐতিহ্য, চিঠিপত্র আদান–প্রদানের সোনালি অতীত কি ফেরানো যায় না? কেউ কি সাদা কাগজে রঙিন খামে লিখবে না, প্রিয় বন্ধু, প্রথমে আমার সালাম নিও...পত্রসাহিত্যের সোনালি দিনগুলো আবার ফিরুক। চিঠিই হোক প্রিয়জনের দুঃখ ভুলানোর আসল হাতিয়ার।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও অনলাইনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় আমাদের জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই নিত্যনতুন পরিবর্তন লক্ষণীয়। কিন্তু এ অনলাইন যে অলস, আবেগ, অনুভূতি, মায়া, মমতা লোপ করে দিচ্ছে আমাদের মধ্য থেকে, তা নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে। ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমকে সবকিছুতে প্রধান না বানিয়ে বরং যখন ভার্চ্যুয়ালি প্রয়োজন তখন ভার্চ্যুয়াল এবং অন্যান্য সময় অফলাইনের সে চিঠিপত্রের ঐতিহ্য, বন্ধুবান্ধব নিয়ে নদীর ধার, সবুজ ঘাসের ওপর বসে সেই হইহুল্লোড় আড্ডার দিনগুলো আবার ফিরুক।

আবার ডাকপিয়ন দরজায় কড়া নেড়ে বলুক, আপনার নামে রঙিন খামে একটি চিঠি এসেছে।

  • লেখক: মারুফ হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়