বাল্যবিবাহের অবসান এক্ষুনি প্রয়োজন
আইনি পরিভাষায় ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ অর্থ বিবাহের ক্ষেত্রে ২১ (একুশ) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ (আঠারো) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো নারী অথবা উভয়ের মধ্যে যে কোন একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও অন্য একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক হলেও তাঁদের মধ্যে বিবাহ সংঘটিত হওয়াকে বাল্যবিবাহ বলে। সময়ের প্রয়োজনে ও পরিস্থিতির বিবেচনায় ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইনের সংশোধনী আনা হয় ২০১৭ সালে। সংশোধিত আইনে, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ রয়েছে। আইন অনুযায়ী বাল্যবিবাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের শাস্তি, বাল্যবিবাহ করবার শাস্তি, বাল্যবিবাহ সংশ্লিষ্ট পিতা-মাতাসহ অন্যান্য ব্যক্তির শাস্তি, বাল্যবিবাহ সম্পাদন বা পরিচালনা করবার শাস্তি, বাল্যবিবাহ নিবন্ধনের জন্য বিয়ে নিবন্ধকের শাস্তি, লাইসেন্স বাতিল, মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর প্রয়োগ, ইত্যাদি উল্লেখ থাকলেও কোনো কিছুতেই যেন বাল্যবিবাহ কমছে না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশটি যখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তক্ষুনি বাল্যবিবাহের মতো ক্ষতিকারক বিষয়টি ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।
বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়, দারিদ্র্য ও অশিক্ষাকে মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাস্তবতা অন্য কথা কথা বলে। ইউনিসেফের একটি গবেষণার তথ্যমতে, ৫০ শতাংশের অধিক বাংলাদেশের নারী, যাঁদের বয়স এখন ২০–এর মাঝামাঝি তাঁদের ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে। প্রায় ১৮ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৫ বছরের নিচে। দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিতে সন্তানদের বিয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত পিতা-মাতাই মূল ভূমিকা পালন করে থাকেন। যেহেতু আমাদের সমাজব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়, তাই পরিবারের মানসম্মানের কথা বিবেচনা করে, মেয়েদের সাধারণত বোঝা হিসেবে মনে করা হয়।
যেহেতু বাল্যবিবাহ একটি বড় সমস্যা এবং এটি প্রতিরোধের জন্য আইনের সংশোধন আনা হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে এটি নিঃসন্দেহে জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তরায় বটে! অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবক বিষয়টি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলেন। ‘শিশুদের বিয়ে দেওয়া যে একধরনের যৌন নির্যাতন’, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা তা বিশ্বাস করতে চান না। ফলে যেসব কিশোরীর বিয়ে হয়, তারা আগাম গর্ভবতী হয় ও সম্ভাব্য নেতিবাচক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে থাকে।
তবে কি আমরা বড়রাই বাল্যবিবাহের মতো অপরাধের জন্য দায়ী? কোনো সন্দেহ নেই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি প্রচলিত নানা প্রথাও অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী! ‘বাল্যবিবাহ’ কেবল একটি একক কোনো সমস্যা নয়, বরং এটি অন্য অনেক সামাজিক সমস্যা ঘটানোর জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত। স্বাস্থ্যগত ক্ষেত্রেও ঝুঁকিতে রয়েছে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা। একটি গবেষণা বলছে, কেবল জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১১ হাজার নারী মারা যান। আর এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন প্রায় পাঁচ কোটি নারী। চিকিৎসকদের মতে, জরায়ু ক্যানসারের মূল সাতটি কারণ হলো অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, বাল্যবিবাহ, অধিক সন্তান প্রসব, ধূমপান বা তামাক সেবন, ঘনঘন সন্তান প্রসব, স্বেচ্ছায় গর্ভপাত এবং প্রজনন শিক্ষার অভাব। তবে যেসব পুরুষ একাধিক নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন, তিনি বাহক হিসেবে প্যাপিলোমা ভাইরাস অন্য নারীর দেহে ছড়াতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে ওই পুরুষও লিঙ্গ ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। অতএব এটি সুস্পষ্ট, উল্লিখিত সমস্যার ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ একটি অন্যতম কারণ। গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা রাজিয়া বেগম বলেন, বাংলাদেশের নারীদের আক্রমণকারী ১০ ধরনের ক্যানসারের মধ্যে জরায়ুর ক্যানসার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, যা ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। অনেক নারী জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। অথচ তাঁর পরিবার জানেন না তিনি কী কারণে মারা যাচ্ছেন।
সামাজিক আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে মেয়েদের জন্য বিয়ের বয়সকে বিলম্বিত করার সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। দেশের উন্নয়ন সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে তৎপর রয়েছে। মেয়ে ও ছেলে উভয় শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা ও উন্নতিলাভের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিশ্চিত করার এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে কমিউনিটিভিত্তিক অংশগ্রহণমূলক থিয়েটার, যেকোনো উন্নয়নবিষয়ক আলোচনাকালীন বাল্যবিবাহের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা, উঠান বৈঠক, রেডিও ও টিভি নাটকের সিরিয়াল (শিক্ষামূলক) এবং কোনো অনুষ্ঠানের মধ্যে ফোনে আলাপ করা, সম্প্রদায়ভিত্তিক ঘোষণা এবং অন্যান্য বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যবিধির সুবিধা ছাড়াও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা করা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। এরূপ কার্যক্রম মেয়েশিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি ও বিদ্যালয়ে তাদের ভর্তির বিষয়টিতে অনুপ্রাণিত করবে। ফলে বাল্যবিবাহের হার কমে যাবে।
ইউনিসেফের গবেষণা মতে, বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ নারী বাল্যবিবাহের শিকার, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ এবং বিশ্বে অষ্টম। অর্থাৎ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ তাজা প্রাণ। অন্যভাবে বলা যায়, সম্ভাবনাময় জীবনগুলোকে তথা আমাদের জাতির একটা বড় অংশকে গলা টিপে হত্যা করছি আমরাই। সুন্দর শৈশব কেড়ে নিয়ে, শিক্ষাজীবনকে লাথি মেরে ‘বাল্যবিবাহ’ নামক অবৈধ খেলায় বাধ্য করছে আমাদের সভ্য সমাজ, এমনকি স্বয়ং মা-বাবা! লৌকিকতা, যৌতুকের ভয়াল থাবা আর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার দোহাই দিয়ে বাল্যবিবাহ সম্পাদন কেবল একটি অপরাধই নয়, বরং জাতির জন্য চরম লজ্জার! সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় জাতি যতই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হোক না কেন, কেবল ‘বাল্যবিবাহের’ মতো ন্যক্কারজনক বিষয়টি অনেক সুন্দর সম্ভাবনা আর ভালো অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে সমূলে। তাই আমরা যদি এর হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই, তবে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ‘বাল্যবিবাহের অবসান এক্ষুনি প্রয়োজন’! নয়তো ইতিহাসের পাতায় আমরা পৈশাচিক জাতি হিসেবে চিহ্নিত হব।
লেখক: মো. তানজিমুল ইসলাম, অ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর, ওয়ার্ল্ড ভিশন