ভালো লাগা এবং ভালোবাসা
স্কুলজীবন থেকে শুরু করে এখন অবধি জীবনের বাঁকে বাঁকে অসংখ্যবার ‘ভালো লাগা’ শব্দটির প্রেমে পড়েছি। কিন্তু উভয় পক্ষের ইতিবাচক সাড়ার অভাবে ‘ভালোবাসা’ শব্দটির প্রেমে পড়া হয়নি। যদিও তার সঙ্গে সখ্য সেই ছোটবেলা থেকেই। একসঙ্গে শৈশব পেরিয়েছি, কৈশোর পেরিয়েছি, এমনকি যৌবনের শুরুতেও তার সঙ্গে ছিলাম। এ সময়ে তার সঙ্গে কত পূর্ণিমা রাত পার করেছি; কত মধ্যদুপুরে তপ্ত রোদে হেঁটেছি; কত বিকেল ঘুড়ি উড়িয়ে পার করেছি; কত গোধূলিলগ্নে আলো-আঁধারির লুকোচুরি উপভোগ করেছি; কত খুনসুটি করেছি; কত মায়ের বকুনি খেয়েছি; কত স্কুল পালিয়ে সময় দিয়েছি এবং কত পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়েছি তার হিসাব মেলানো কঠিন। এত কিছুর পরও এ সময়ে তার প্রতি কোনো ভালোবাসা জন্মায়নি।
পড়াশোনার জন্য গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার কারণে তার সঙ্গে একটা সময় যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদে ভর্তির সুবাদে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও তার সঙ্গে আবার দেখা, আবার একসঙ্গে পথ চলা শুরু। এ পথচলায় তার জন্য কেয়ার মার্কেটের ফটোকপির দোকানে কত দাঁড়িয়ে থেকেছি; জব্বারের মোড়ে বন্ধুদের সঙ্গে কত চায়ের কাপে ঝড় তুলেছি; অ্যাগ্রোনমি ফিল্ডে কত অলস দুপুর পার করেছি; পোলট্রি ফার্মে হাওলাদার স্যারের এবং ডেইরি ফার্মে ওয়াদুদ স্যারের বকা খেয়েছি; ডেইরির মোকতার স্যার, বায়োকেমিস্ট্রির মোর্তজা স্যার, জেনেটিকসের ফারুক স্যার, নিউট্রিশনের শাহজালাল স্যার, প্যারাসাইটোলজির জাহাঙ্গীর স্যার, অ্যানিমেল সায়েন্সের রইসুল আলম স্যারদের মতো ভয়ংকর শিক্ষকদের মুখোমুখি হয়েছি; কত জেনেটিকস, ডেইরি, পোলট্রি ও নিউট্রিশন ল্যাবে সময় কাটিয়েছি; মাথার ভেতর ডিএনএ, আরএনএ, মেটাবলিজম, বায়োকেমিস্ট্রির সমীকরণ মেলাতে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি; বোটানিক্যাল গার্ডেনে গাছের ছায়ায় বসে কত অলস বিকেল পার করেছি, শাহজালাল হলের পুকুরপাড়ে বসে কত চোখের জল ফেলেছি, শহীদ মিনারে পাদদেশে কত মশার কামড় খেয়ে সন্ধ্যা পার করেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে বড় বড় বিদেশি লেখকদের বইয়ে ডুবে সময় কাটিয়েছি, ব্রহ্মপুত্র নদে পাল তোলা নৌকায় বসে কত স্বপ্নের জাল বুনেছি; তাকে ভালোভাবে বোঝার জন্য কত সকাল না খেয়ে ক্লাসে দৌড়াইছি, কত পৌষ-পার্বণ, নবান্নের আনন্দ বিসর্জন দিয়েছি। এত এত স্মৃতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি বছর পার করলেও তাকে ভালোবাসতে পারিনি।
এরপর শুরু হলো বাংলাদেশ লাইভ স্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (বিএলআরআই) চাকরিজীবন। এখানে এসেও সে আমার পিছু ছাড়েনি, সব ক্ষেত্রেই ছিল তার সরব উপস্থিতি। এখানেও তাকে নিয়ে কত ল্যাবে সময় কাটিয়েছি; ফার্মগুলোতে কত ঘোরাঘুরি করেছি; দেশের স্বনামধন্য কত বিজ্ঞানী ও শিক্ষকদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক, কত আলোচনা-সমালোচনা করেছি; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেটে বসে থাকা অলস বিকেলের আড্ডাতেও তার প্রসঙ্গ বাদ যায়নি। এই লম্বা পথ চলায় জীবনের প্রতিটি বাঁকেই সে আমার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল, কিন্তু তার বাহ্যিক অবয়ব কখনোই আমাকে আকর্ষণ করতে পারেনি। মনে হয়, তার বাহ্যিক সৌন্দর্যের দিকে দৃষ্টি দিতে গিয়ে তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যগুলো চোখে পড়েনি বলেই তাকে ভালোবাসতে পারিনি।
এরপর ব্যক্তিগত জীবনে একটু ভালো থাকা, সৎভাবে বেঁচে থাকা, রাজধানীতে থাকার অভিপ্রায় নিয়েই পিকেএসএফে চাকরি নেওয়া। পিকেএসএফে চাকরির পর থেকে এখন অবধি তাকে নিয়ে কত লেখা, কত চিন্তা, কত গবেষণা, দেশের এপ্রান্ত–ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়ানো, কত মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে, তার হিসাব মেলানো কঠিন। চাকরির সুবাদে খুব কাছ থেকে অনেক দরিদ্র মানুষের জীবন পরিবর্তনের অনুষঙ্গ হিসেবে তাকে দেখেছি, দেখেছি দেশের অর্থনীতিতে তার বিশাল অবদানের কথা, পাশাপাশি তার জন্য ব্যক্তিজীবনেও গুণগত পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তনই আমাকে তার বাহ্যিক অবয়ব থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য করছে। জীবন পরিক্রমায় এত লম্বা সময় একসঙ্গে পথ চলার পর ইদানীং মনে হচ্ছে, আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। বাকিটা জীবন ভালোবেসে যেতে চাই।
লেখক: মজনু সরকার, ব্যবস্থাপক, পিকেএসএফ