বাঁশকোরলের নানা স্মৃতি
পাহাড়ে জনপ্রিয় খাবারের তালিকায় বাঁশকোরল অন্যতম। বাঁশকোরল পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবনে এতটাই জড়িয়ে আছে যে এটি কখনো চোখের জলে ভাসিয়ে ছাড়ে। বাঁশবনে বা জঙ্গলে একসঙ্গে বাঁশকোরল খুঁজতে গিয়ে বহু তরুণ-তরুণীর মধ্যে প্রেম–ভালোবাসার সম্পর্ক হয়েছে—এমন নজিরও আছে।
বৃষ্টির দিনে বাগানে কাজ করা যায় না। ওই সময় ভিজতে ভিজতে দল বেঁধে বাঁশকোরল খুঁজতে যান পাহাড়ি গৃহবধূ ও তরুণ-তরুণীরা। বাঁশকোরলের পাশাপাশি পাহাড়ি ছড়ায় কাঁকড়া ও চিংড়ি ধরা ছাড়াও কুজুপোঙাসহ (কচুফল) নানা তরিতরকারি সংগ্রহ করা হয়। আগেকার দিনে অনেক বেশি হতো।
বাঁশকোরল খুঁজতে গিয়ে বিষধর সাপের কামড়ের বিষাদময় স্মৃতিও আছে বহু মানুষের। জঙ্গল থেকে খুঁজে আনা বাঁশকোরল প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাগ করে খাওয়ার মধ্যে যে মধুর অনুভূতি, এতে যে সম্প্রীতির ভাব রচিত হয়, তা চিরকালের স্মৃতি হয়ে থাকে। জীবনের গল্পগুলোতেও স্থান করে নেয়।
রান্নার পর বাঁশকোরলের দুটি অংশ হয়—‘ভাচ্ছোরি তং’ ও ‘ভাচ্ছোরি আগা’। অনেকের পছন্দ আগা। মায়েদের নিজের ছেলেমেয়েকে ভালোবেসে ভাতের থালায় ভাচ্ছোরি আগা তুলে দিতে দেখা যায়।
বাঁশকোরলের সঙ্গে হাঁসের মাংস রান্না করলে দারুণ সুস্বাদু হয়। চাকমা ভাষায় একটা কথার চলন আছে, তা হলো ‘আহ্জ’ (হাঁস) তোন-বাঁশ তোন, গুই এ্হরা-বিগুন তোন।’ অর্থাৎ বাঁশকোরলের সঙ্গে হাঁসের মাংস এবং বেগুনের সঙ্গে গুইসাপের মাংস মিলিয়ে রান্না করলে খুবই সুস্বাদু হয় তরকারি। তরকারিকে চাকমা ভাষায় ‘তোন’ বলা হয়।
বাঁশকোরল রান্না করে, ভাজি করে, সেদ্ধ করার পর কোরবুও বা চাটনি বানিয়ে খাওয়া যায়। বর্তমান সময়ে মুরগির মাংসের সঙ্গে ‘ভাচ্ছোরি কোরবুও’ পাহাড়ি রান্নায় নতুন সংযোজন বলা যায়। এ ছাড়া পাতায় মুড়িয়ে বিশেষ কায়দায় পচিয়েও কয়েক দিন রেখে তারপর রান্না করে খাওয়া যায়। পাতায় মুড়িয়ে বিশেষ কায়দায় রাখা ওই বাঁশকোরলকে বলা হয় ‘মিদুককোয়্যা’। মিদুককোয়্যা খেতেও বেশ মজা।
ভাইবোন, মা-ছেলে, মা-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বাঁশকোরল খোঁজার স্মৃতি অনেক মধুর। গভীর ভালোবাসামাখা স্মৃতি থাকে। ভাইবোনের সঙ্গে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে একত্রে বাঁশকোরল খোঁজার কথা মনে করে কেউ কেউ চোখের জল ঝরান।
কেউ কেউ ভাবেন, মায়ের সঙ্গে অমুক জায়গা থেকে কতই বাঁশকোরল নিয়ে এনেছিলাম।
বাজারে বাঁশকোরল বিক্রি করতে আসা মাঝবয়সী নারীর চেহারায় নিজের মায়ের মুখচ্ছবি দেখতে পান অনেকেই। কেউ জীবিত মায়ের ছবি, কেউবা স্বর্গত মায়ের ছবি।
ছেলেবেলার বন্ধুবান্ধবের ছবিও চোখে ভাসে আর মনে পড়ে বাঁশকোরল দেখলে। বাঁশকোরল নিয়ে গল্প লেখা যায়। স্মৃতিকাতর হওয়া যায়। অশ্রু ঝরানো যায়। গল্প বলা যায়। প্রেমের কাহিনি স্মরণ করা যায়। অতীতেও ফেরা যায়।