হাসান আরিফের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য

‘আমার প্রিয় আরিফ ভাই।’ ৩০ বছর ধরে যাঁরাই আরিফ ভাইকে চেনেন, তাঁরা সবাই বলবেন, ‘আমার প্রিয় আরিফ ভাই।’ তিনি একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ‘সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব’ শব্দটি অধুনা ব্যবহৃত একটি পরিচিতি। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার প্রতিটি অক্ষরব্যঞ্জনার প্রেমিক। তিনি অন্তরের অন্তস্তল থেকে বাংলা ভাষাকে, দেশকে, নিজের মাতৃভূমিকে লালন করতেন। তিনি এক বিশাল সমুদ্রের তরঙ্গরাজি, নিজের হৃদয়ের মধ্যে তরঙ্গমালা ধারণ করতেন। তাঁর প্রতিটি তরঙ্গ ছিল একেকটি বাংলা কবিতার স্তবক আর হৃদয়ের উচ্ছ্বাস ছিল স্রোতস্বিনী নদীর মতো উচ্ছল। তিনি তথাকথিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নন, তিনি ছিলেন এক নিভৃত প্রেমিক। বাঙালি সংস্কৃতি ও দেশের জন্য, দেশের মানুষের চেতনা, সামাজিক চেতনায়, কখনো শিল্পের তাড়নার জন্য কত যে পথ হেঁটেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণের কোনায় কোনায়! প্রতিটি কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ও জারুলের পাতাঘেরা পথে প্রতিবাদে, মিছিলের স্লোগানের সঙ্গে, কবিতা, দেশের ক্রান্তিকালে রাজনৈতিক চেতনায়, সামাজিক চেতনায়, গীতি ও কবিতা, পথনাটক ও গানের যাত্রায় একান্ত নিবিষ্ট মনে পথ হেঁটেছেন। নিভৃতে নির্জনে নিজের আত্মার ও শরীরের সুখের ভাবনা তিনি করেননি, খুঁজেছেন একুশের পদযাত্রায় কোন কবিতার পর কোন কবিতা সাজাবেন। কেটেছে তাঁর বিনিদ্র রজনী।

কখনো তাঁর আত্মভোলা হাসিমাখা চেহারায় ছিল না ক্লান্তি বা খেদের কথা। শুধুই নতুন থেকে নতুন করে উৎসবকে নব নব পঙ্‌ক্তিমালায় সাজানোর প্রচেষ্টা। তাঁর অসীম ধৈর্য ও ত্যাগ আজ অনেক তরুণ আবৃত্তিশিল্পী ও সংস্কৃতিপ্রেমিকের প্রেরণার পাথেয় হবে।
ব্যক্তিগত জীবনে নিরহংকার সাদাসিধে আত্মভোলা মানুষটি কখনো কোনো আধুনিক বিলাসবহুল আড়ম্বর জীবনের দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেননি। নিজ দেশের মানচিত্র ও পতাকার তলায় ছিলেন নিপাট, নির্লোভ মানুষ। তাঁর শরীরও পোশাকের মতোই, তাঁর জীবন ছিল সরল নদীর মতো।

চিরপরিচিত লোভনীয় পথগুলো খুব সযত্ন পরিত্যাগ করেছেন। একটি কবিতার জন্য তিনি প্রহরের পর প্রহর বসে থাকতে পারতেন। বন্ধু-কবি তারিক সুজাতের কবিতা নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হৃদয়ে ধারণ করে, প্রাণের অধিক ভালোবাসায় তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠে উপস্থাপন করতেন। এটি প্রগাঢ় সাধনার কাজ। মনে আছে, তিনি কবি তারিক সুজাতের ‘আকাশপুরাণ’ কবিতার মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, ‘আজ আকাশের মন ভালো নেই, তারাও নিরুত্তর’ এখানে দুটি চরিত্র আছে আকাশ ও তারা। তিনি নিবিষ্ট মনে নিজ আগ্রহে ‘আকাশপুরাণ’ কাব্যগ্রন্থটি তাঁর হৃদয়ে ধারণ করে আবৃত্তি করেছেন।

আরও যে কত কবিতা নিজ আনন্দে নিজের মনে ও শ্রোতাদের জন্য আবৃত্তি করেছেন, তা বলা ও সংখ্যা গণনা করা অসম্ভব। আমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা আবারও লিখব, শুধু আমি নই—এই কথা আজ অনেকেই ভাবছেন।

কবি ও কবিতার সঙ্গে একাত্মতায় তিনি ছিলেন নিভৃত এক পথচারী। তিনি ভিড়ের মধ্যেও ছিলেন একান্ত একা। এটি সাধনা, শিল্পের প্রতি অনুরাগ। আবৃত্তিশিল্পী, আবৃত্তিকার হয়তো অনেকেই আছেন, কিন্তু এমন বাস্তুত্যাগী, পথহারা পথিক, পাগল প্রেমিক কমই হয়। আমার কাছে তিনি এক অকৃত্রিম ভালোবাসার মানুষ, যাঁর হৃদয় সফেদ–সাদা আর তাই তাঁর নিজের ভুবনে, নিজের উচ্চারিত শব্দের এক প্রেমিক।