স্মৃতির হৃদয়ে হাজারো স্বপ্ন গাঁথা, চায় কৃত্রিম পায়ে দাঁড়াতে

জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী আবিদা আনজুম স্মৃতি লেখাপড়া করে ব্যাংক কর্মকর্তা হতে চান ভবিষ্যতে।

‘আব্বার কথা মায়ের মনে নেই, আর মনে থাকবেই–বা কেমন করে। মায়ের কাছে শুনেছি যখন আমার বয়স এক বছর, তখন আব্বা মারা গেছেন। আব্বা খুব আদর করতেন নাকি আমাকে, বলতেন আমার মেয়ে সবার কাছে স্মৃতি হয়ে থাকবে। স্মৃতি হুইলচেয়ারে বসে লেখাপড়া করবে, সে অনেক বড় চাকরি করবে দেখিস তোরা। জন্মের পর থেকে দুটো পা নেই আমার, মা, ভাইবোনেরা কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে—জীবনে এই ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারব না আমি। আমি কোনো দিন একটা স্বাভাবিক মানুষের মতো দাঁড়াতে পারব না, হাঁটতে পারব না—এ আক্ষেপটা নিয়ে আমার সারা জীবন বাঁচতে হবে। প্রতিবন্ধী মানুষ থাকা মানে পরিবারের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকা, কিন্তু আমি যে এ জীবনটা কখনোই চাইনি, সব সময় নিজে স্বাবলম্বীভাবে বাঁচার চেষ্টা করেছি—এখনো পথ খুঁজেছি। সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এখন পর্যন্ত মাদ্রাসার আলিম শাখার দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন বাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার দূর দুটো হাতের সাহায্যে মাদ্রাসায় আসা যাওয়া করি। এখন অভাবের সংসারে জানি না আর কত দিন লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে পারব, তবু স্বপ্নটা আমি দেখি আমি লেখাপড়া করে সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করব। হয়তো আমার স্বপ্নটা পূরণ হবে, আমার জনম দুঃখী মায়ের জন্য—পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। আর শুনেছি কৃত্রিম পা লাগিয়ে আমার মতো অনেক স্মৃতি চলাফেরা করছে, সেই সামর্থ্য কোনো দিন হবে না আমার পরিবারের।’
চোখ তার জলে আবছা ভেজা, কপালের জমে আছে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম, একটু পরপর ওড়নায় নাক-কপাল মুছে নিচ্ছে স্মৃতি। মাথার ওপর কড়া রোদ্দুর, পুকুরপাড়ের গুল্মলতা গাছের ডগাগুলো তির তির করে আকাশ ছুঁয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে রোদ কেটে। এমন ভরদুপুরে পুরোনো পুকুরঘাটে বসে শুনছিলাম অদম্য সাহস আর প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, একটা মিষ্টি তরুণীর বুকের তাবৎ বেদনার স্মৃতির কথামালা—আগামীর স্বপ্নপূরণের দিনগুলোর কথা।

পুরো নাম আবিদা আনজুম স্মৃতি, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নে ভবানীপুর টান পাড়া গ্রামের মৃত আবদুল আউয়ালের পাঁচ সন্তানের সবার ছোট মেয়ে স্মৃতি। স্মৃতি ভবানীপুর সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। পরিবারের অন্য ভাইবোনেরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করলেও সবার থেকে ব্যতিক্রম স্মৃতি। কারণ, জন্ম থেকেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয় এই মেয়েটি পৃথিবীতে। স্মৃতির জন্মের পর মা সুফিয়া খাতুনের জ্ঞান ফেরার পর সে দেখে তার মেয়ে স্মৃতির কোমর থেকে দুটো পা নেই। তখন এ নিয়ে পরিবার ও সমাজের মানুষের কাছে নানান কটু কথাও শুনতে হয়েছে মা সুফিয়া খাতুনকে।

পৃথিবীর বুকে হয়তো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো দুই পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে পৃথিবীটাকে না দেখতে পারলেও তার দুটো হাত আছে। মেধা–মননশীলতাকে কাজে লাগিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কাছে দমে না গিয়ে বরং নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে স্মৃতি প্রতিনিয়ত। তবু মানুষ যে খুঁজে ভাতের ঠিকানা, দিন শেষে অভাব-অনটন আর দারিদ্র্যের কাছে হার মানে—এমন অজস্র স্মৃতিরা। কেননা, জীবনের চাকা চালাতে গিয়ে কখনোসখনো ভাগ্যের চাকা থেমে যায় তাদের শুধু অভাব–অনটনের তাড়নায়। যার কারণে এই মেয়েটির এখন পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম, বাড়ি থেকে তার মাদ্রাসার দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। আসা–যাওয়ায় জন্য মোট ছয় কিলোমিটারের এই দূরের পথ স্মৃতি তার দুটো হাতের সাহায্যে পুরোটা পথ পড়াশোনা করতে মাদ্রাসায় যায় ফুটফুটে এই মেয়েটি এখন। মৃত্যুর আগে স্মৃতির বাবা আবদুল আওয়াল যত সামান্য অল্প একটু জমি রেখে গিয়েছিলেন, তা চাষবাস করে কোনোরকমে দুবেলা অন্ন জোটে এই ১০ সদস্যের পরিবারটির। সরকার থেকে একটি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড পেয়েছে স্মৃতি।

স্মৃতির বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবানীপুর সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোবারক আলী বলেন, ‘স্মৃতি আমার ছাত্রী। সে খুব ভালো শিক্ষার্থী। আমি অবাক হয়ে যাই তার ভেতর যে শিক্ষার তথা লেখাপড়া করার তুমুল আগ্রহ দেখে। খুব কষ্ট করে মেয়েটি হাতের সাহায্যে পড়াশোনা করতে আসে, সরকার যদি স্মৃতির পড়াশোনার ব্যাপারটা এবং তার পরবর্তী সময়ে পড়াশোনা শেষ করার পর একটি চাকরির সুযোগ করে দেয়, তাহলে মেয়েটির জন্য খুবই উপকার হবে। স্মৃতি আমাদের দেশে যত প্রতিবন্ধী মানুষ আছে, সবার জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আসলে ইচ্ছা আর সাহস থাকলে এগিয়ে যাওয়া যায়, এই মুহূর্তে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সবাইকে পাশে থেকে স্মৃতির স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।’

নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে
পড়াশোনার পাশাপাশি ঘরে বসে আর্টিফিশিয়াল চুল বা পরচুলা তৈরির কাজ করে। এ কাজে প্রতি মাসে ১ হাজার থকে ১ হাজার ৫০০ টাকা উপার্জন করতে পারে স্মৃতি। তা থেকে কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে তার নিজের বই-খাতা কিংবা ছোটখাটো এক–আধটা শখ পূরণ করতে পারে স্মৃতি। পড়াশোনা শেষ করে ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চায়, পাশাপাশি ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে পরিচিতি ঘটাতে কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে নিজেকে আরও এগিয়ে রাখতে ইচ্ছা প্রকাশ করে এই মেয়েটি। এ জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি একটি ল্যাপটপের দাবি তার সমাজের বিত্তবানদের কাছে। সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য চাকরিসহ নানান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকলেও আদতে প্রান্তিক পর্যায়ে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে সে সুযোগ–সুবিধাগুলো পরিপূর্ণভাবে পায় না বলে দাবি করে স্মৃতি।

জন্মের পর মাত্র এক বছর বয়সে স্ট্রোক করে মারা যান স্মৃতির বাবা। তারপর তার মা তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন।

পরিবারের সবার ছোট মেয়ে স্মৃতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত মা সুফিরা খাতুন বলেন, ‘আমার পাঁচ সন্তানের মধ্যে ছোট মেয়া স্মৃতি একমাত্র ওই প্রতিবন্ধী হইয়া জন্ম নিছে। এক বছর বয়স রাইখা ওর বাপ মারা গেছে। আমার স্মৃতির মেলা লেহাপড়া করতে চায়, পড়ালেহা কইরা ব্যাংকে চাকরি করতে চায় অর লেহাপড়া করার খুব ইচ্ছা। আমগোর জমিজমা নাই যেখানে সংসার চালাতে কষ্ট হয়, সেহানে লেখাপড়া করামু কি দিয়া।

সুফিয়া খাতুন আরও জানাযন, ‘যে যা–ই বলুক মেয়ে আমার। আমি জানি আমার মেয়ের যন্ত্রণার কথা, চিন্তায় আমার ঘুম আসে না বাবা, আমার মেয়েটা বড় হয়েছে, তার দুইটা পাও (পা) নাই প্রতিবন্ধী আমার মেয়েটারে বিয়া দেওন লাগব। কিন্তু কেডায় বিয়া করব আমার মেয়ারে। একজন মা হয়ে এটা একটা বড় চিন্তা আমার, বেঁচে থাকতে তার যদি একটা গতি হইত, অর মনের ইচ্ছাগুলো যদি পূরণ হোত আর চাওয়া ছিল না আল্লার কাছে।’

স্মৃতির বড় ভাই ফকরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বোনটা খুব ধৈর্যশীল, সে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। সাংসারিক অসচ্ছলতার কারণে বোনটাকে সব সময় সহযোগিতা করতে পারি না। একটা ল্যাপটপ কেনার খুব শখ ওর, কিন্তু আমাদের তো নুন আনতে পান্তা ফুরায়। দুটো হাতে কহর পড়ে গেছে, হাত দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছয় কিলোমিটার পথ আসা-যাওয়া করে স্মৃতি। কলেজে আসা–যাওয়া করতে একটা হুইলচেয়ার কিংবা মোটরচালিত হুইলচেয়ার বানিয়ে দিতে পারলে সে নিজেই স্কুলে আসা–যাওয়া করতে পারত। সেই সামর্থ্য আমাদের কোনো দিনই হবে না। সরকার প্রতিবন্ধীদের চাকরি জন্য সুযোগ–সুবিধা দিয়েছে আমার বোনটা যদি একটা সরকারি চাকরি হয় এবং আমার বোনের পড়াশোনার খরচটা যদি সরকার কিংবা বেসরকারি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বহন করত, আমার বোনের স্বপ্নটা পূরণ হতো।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, স্মৃতির মতো এমন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষেরা পরিবারের বা সমাজের বোঝা নয়। প্রান্তিক পর্যায়ে এমন অনেক স্মৃতিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এ দেশে, যারা নাকি একটু সহযোগিতা বা মানবিকতার অভাবে পিছিয়ে পড়ে থাকে আজন্মই। তাদের প্রতি মানবিক আচরণ আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই তারা হতে পারে দক্ষ জনশক্তি তথা দেশের সম্পদ। তাই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত স্মৃতির মতো এমন প্রতিবন্ধীদের ভাগ্যোন্নয়নে আরও কর্মপরিকল্পনা বৃদ্ধিসহ এই মানুষগুলোকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।
লেখক: ইমতিয়াজ আহমেদ, ময়মনসিংহ।