সাদা-কালো টিভিতে রঙিন শৈশব

একসঙ্গে সবাই মিলে টিভি দেখা
ছবি: লেখক

আজ থেকে ১০-১২ বছর আগের কথা। কৈশোরের বেশির ভাগ সময় আমার কেটেছে মামাবাড়ি। মেঘনা নদীর এপাড় ঘেঁষে আমাদের বাড়ি, ওপাড় ঘেঁষে মামাবাড়ি। শৈশব, কৈশোরের অধিকাংশ সময় মামাবাড়িতে বড় হয়েছি। বড় হয়েছি, মামাদের সঙ্গেই। স্কুলে বৃহস্পতিবার দিন সব সময় হাফ ক্লাস হতো। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরেই চলে যেতাম মামাবাড়ি। নৌকাতে যেতে হয়, তখন ভাড়া ছিল মাত্র ৫ টাকা ছোট ছিলাম বলে ফ্রিতেই নিয়ে যেতেন আব্দুল খালেক মাঝি। নানা তখনো আমাদের ছেড়ে যায়নি পরপারে। নানা-নানি জানতেন, প্রতি বৃহস্পতিবার আমি আসব। যদি কখনো কোনো দিন যেতে না পারতাম, নানা ঠিক চলে আসতেন নৌকা নিয়ে। মামাদের সঙ্গে লাঠিম, ক্রিকেট, বর্ষাকালে ধইঞ্চাগাছ দিয়ে ডাংগুলি খেলা, দুপুর বেলা একসঙ্গে নদীতে ঝাঁপাঝাপি করা, রাতের বেলা প্রচণ্ড গরম থাকা সত্ত্বেও ৭-৮ জন একসঙ্গে এক খাটে ঘুমিয়ে থাকার সময় ছিল সবচেয়ে সুখকর। সেই থেকে সমবয়সী ও ইমেডিয়েট সিনিয়র মামাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে আমার সখ্য, সম্পর্কটা মামার বদলে রূপ নেয় বন্ধুত্বে।

১২ বছর আগে যখন মামাদের গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ আসেনি, হারিকেন, মোমের আলোর প্রতি নির্ভরশীল ছিল মামাদের গ্রামের সব মানুষ। প্রায় সময় সবাই বাড়ির উঠানে মাদুর বিছিয়ে খোলা আকাশের নিচে চাঁদের দিকে তাকিয়ে নানা রকম গল্প, ভূতের গল্প, রাজা-রানির গল্প, রূপকথার গল্প শুনে শুনে ঘুমানো হতো। গল্প শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম আমরা। রাতে তখন প্রতিটি ঘরের দরজা খোলা থাকত। আজকালের মতো এত চোর-ডাকাত ছিল না তখন। প্রয়োজনীয় অনেক কিছু অবলীলায় বাইরে রেখে দিত মানুষ।

গ্রামে তখন সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার শুরু হয়। নানার ঘরে তখন সাদ–কালো টিভি ছিল। বাড়ির সবাই মিলে প্রতি মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার টিভির সামনে দল বেঁধে বসে যেতাম। ‘হানিফ সংকেতের ইত্যাদি, আলিফ-লায়লা, হাতিম, সিসিমপুর’ অনুষ্ঠানই ছিল সবার প্রথম আকর্ষণ। যে যেখানে জায়গা পেত মাটির মেঝেতে কিংবা বাইরে বসে যেত। যেভাবেই হোক পছন্দের অনুষ্ঠানটি দেখতে হবে। মাঝে মাঝেই টিভির লাইন চলে যেত, বারবার ঠিক করা লাগত অ্যানটেনা। সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ ছিল বুঝি এটাই। তখন আমাদের সাদা–কালো টিভিতে ছিল রঙিন শৈশব। তখন নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে সবার নজর ছিল, আলমগীর, শাবানা, মান্না, পূর্ণিমা, রিয়াজ। কমেডি চরিত্র করতেন তখন প্রয়াত দিলদার। তখন সাদা পর্দার সঙ্গে কিছু ছবি উপস্থিত সবার চোখে এনে দিত জল, আবার কিছু ছবি এনে দিত একরাশ অট্টহাসি। কেউ যদি কোনো দিন কোনো ছবি মিস করত, পরের দিন ছবির পুরোটা চিত্রই তার চোখের সামনে তুলে ধরত কেউ কেউ। যেন পুরো ছবিটাই তার মনে গেঁথে আছে।

তখন মামাবাড়িতে টিভি দেখতে দেখতে খেয়াল থাকত না রাত কয়টা বাজে। ঘর থেকে দূরে একটা টর্চলাইটের আলো দেখা যেত। টর্চের আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে টিভি দেখা জন কুড়ি মানুষ কে কোনো দিক দিয়ে পালিয়েছে ঠিক নেই। মুহূর্তের মধ্যে ঘর খালি হয়ে যেত যত স্বাদের অনুষ্ঠানই হোক। বুঝতে দেরি হতো না যে নানা আসছেন ঘরের দিকে। বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নানা মামাদের গ্রামের চায়ের দোকানে বসে বসে পঞ্চায়েত কমিটির সঙ্গে গ্রামের বিচার–আচার শেষ করে ঘরে ফিরতেন। দেখতাম বাড়ির সবাই নানাকে ভীষণ ভয় পেতেন। নানা যদি বলতেন ওঠো, সবাই উঠে যেতেন, যদি বলতেন বসো সবাই বসে যেতেন। সবাই খুব সম্মান করতেন। আর আজ নানা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন ৮ বছর হয়ে গেল। আচ্ছা, মামাবাড়ির সেই মানুষগুলো কি নানাকে এখন মিস করেন? নানার শূন্যতা অনুভব করেন?

এভাবেই সময় কেটে যায়, পালাবদল হতে থাকে ঋতুর। আমি–আমরাও বড় হতে থাকি। বড় হতে হতে আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের শৈশব–কৈশোর। হারিয়ে ফেলি সেই রাতের বেলা উঠানে শুয়ে শুয়ে কালো আকাশে শুভ্র চাঁদ, তারা দেখার দিনগুলো। হারিয়ে ফেলি মেঝেতে বসে সাদা–কালো টিভিতে প্রিয় অনুষ্ঠান দেখার সময়টা। হারিয়ে ফেলি প্রিয় মানুষগুলো। বড় হতে হতে অনুভব করি শৈশবটা সুন্দর ছিল। শৈশবের বায়নাগুলো ছোট্ট ছিল, তবে শান্তি ছিল বেশ। হারিয়ে ফেলা প্রিয় শৈশব হয়ে রয় স্মৃতি রোমন্থন।

*লেখক: শিক্ষার্থী