সফুরা খাতুন: ভাওয়াইয়া গানের অনন্য নারী গীতিকার

‘ডাকাইল মুজিব জনসভা, মাইকোত দিল ঘোষণা
স্বাধীন করবে বাংলা হামার, পরাধীন আর থাকপে না।’ (সফুরা খাতুন, ২০২২)

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ দেশের আপামর জনসাধারণ শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিল আজকের লাল সবুজের পতাকা। এর পেছনে রয়েছে রক্তাক্ত ইতিহাস। সেই ইতিহাস স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্মের ভাওয়াইয়া নারী গীতিকার সফুরা খাতুন সেই ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বাণীবদ্ধ করেছেন অনবদ্য সৃষ্টি ভাওয়াইয়া গানে।

সফুরা খাতুন রংপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরবর্তী খটখটিয়া গ্রামে বেড়ে ওঠা এক নিভৃতচারী নারী, যাঁর উত্তরাঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী থাকাকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর সখ্য। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, গল্পকার, উপস্থাপক ও গীতিকার। ছড়া, গল্প, কবিতা রচনা করলেও ভাওয়াইয়া গানের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ। এ প্রসঙ্গে সফুরা খাতুন বলেন, ‘আমার জন্ম ভাওয়াইয়ার আকরভূমিতে। এ গানের ভাব-ভাষা আমাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। এই আকর্ষণ থেকেই মূলত ভাওয়াইয়া গানে অনুপ্রবেশ।’

সফুরা খাতুন ভাওয়াইয়া গানের নারী গীতিকার হিসেবে বাংলাদেশ বেতার, রংপুরে তালিকাভুক্ত হন ২০১৯ সালে। তিনি এখন পর্যন্ত শতাধিক ভাওয়াইয়া গান রচনা করেছেন। তাঁর গানের প্রধান উপজীব্য বিষয় হলো নারী, বিরহ, সমাজ-সংস্কৃতি, দেশপ্রেম, শোষণ-বঞ্চনা প্রভৃতি। এমনকি সমাজ বিবর্তনের ধারাকেও তিনি গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। যেমন ‘অটো এখান কেন পতিধন, অটো এখান কেন/দেও ব্যাচেয়া ধ্যারধ্যারা ঐ বুড়া ইস্কাখানো।’

আবহমান কাল থেকেই গ্রামীণ জনসাধারণের জীবনযাপন, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, মান-অভিমান, অভাব-অনটন প্রভৃতিরই যেন প্রকাশ মাধ্যম হয়ে উঠেছে ভাওয়াইয়া। শুধু তা-ই নয়, এ গানে আছে পল্লির জল-মাটি-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষের নিজস্ব ভাববিলাসী মনের গোপন কথা, আছে নিত্যদিনের সামাজিক-পারিবারিক জীবনের কথা। এ অনুষঙ্গগুলোর প্রধান উপজীব্য হয়েছে নারী। অথচ এ গানের রচয়িতা হিসেবে আমরা শুধু পুরুষকেই পেয়ে থাকি। আজ সর্বত্রই পরিবর্তন লক্ষণীয়। এ পরিবর্তনের ধারায় বর্তমানে ভাওয়াইয়া গানের নারী গীতিকার হিসেবে আমরা সফুরা খাতুনকে পাই।

যিনি নিঃসন্দেহে ভাওয়াইয়া গানের এক অনন্য স্রষ্টা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০০ সালের আগপর্যন্ত একজন গীতিকার বেতারে তালিকাভুক্ত হলে সব ধারার গান লিখতে পারতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা বিষয়ে তালিকাভুক্ত হতে হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, সফুরা একমাত্র ভাওয়াইয়ার নারী গীতিকার, যার আগে কোনো নারী গীতিকারের রচিত ভাওয়াইয়া গান বাংলাদেশ বেতারে প্রচার হয়নি। এ প্রসঙ্গে ভাওয়াইয়ার প্রখ্যাত শিল্পী পঞ্চানন রায় বলেন, ‘সফুরা ভাওয়াইয়ার একমাত্র নারী গীতিকার, যিনি ২০১৯ সালে শুধু ভাওয়াইয়া গানের জন্য গীতিকার হিসেবে নির্বাচিত হন এবং নারী গীতিকার হিসেবে তাঁর গান বাংলাদেশ বেতারে নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে।’

বাংলাদেশ বেতার রংপুরের আঞ্চলিক পরিচালক মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ নারী গীতিকার হিসেবে সফুরা খাতুনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, ‘ভাওয়াইয়া গানের অধিকাংশ স্থানজুড়ে নারী। অথচ এ গানের রচয়িতা হলেন পুরুষ। একজন নারী গীতিকার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে যেভাবে গানের মাধ্যমে নিজের ভাবাবেগকে প্রকাশ করতে পারেন, সে জায়গা থেকে হয়তো একজন পুরুষের পক্ষে ততটা সহজ নয়। আমি মনে করি, সে বিবেচনায় বর্তমান সময়ের নারী গীতিকার হিসেবে সফুরা সফল। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি নিজেকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে চলছেন।’

আরেকজন প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী, সুরকার শফিকুল ইসলাম সফুরা খাতুন সম্পর্কে বলেন, ‘ভাওয়াইয়ার নারী গীতিকার হিসেবে সফুরা আপার গান সুর করা আমার জন্য চরম সৌভাগ্যের। তাঁর গানের গল্প, ধারা বর্ণনা, ভাষার ব্যবহার সত্যিই অসাধারণ। আমি আমার জীবদ্দশায় সফুরা খাতুনের গানের মধ্যে যে ছন্দ, উপমা, অনুপ্রাস খুঁজে পেয়েছি, যা অনেক প্রখ্যাত গীতিকারের গানের মধ্যেও পাইনি।’

সর্বোপরি ভাওয়াইয়া গানের নারী গীতিকার হিসেবে সফুরা খাতুনের আবির্ভাব ভাওয়াইয়া গানের জন্য আশীর্বাদ। তিনি ভাওয়াইয়া গানকে আরও একধাপ এগিয়ে নেবেন বলে দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর এ যাত্রা শুভ হোক, তাঁরই হাত ধরে ভাওয়াইয়া দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বদরবারে স্থান লাভ করুক, সেই প্রত্যাশাই অবিরত।

  • লেখক: ড. এরশাদুল হক, লোকসংস্কৃতি গবেষক ও প্রাবন্ধিক