সন্ধ্যা হলে রেডিও নিয়ে বসে যেতাম

প্রতীকী ছবি

শতাব্দীর সত্তর দশকের কথা—তখন ছোট ছিলাম। প্রাইমারি ছেড়ে উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ি। প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষকদের চেষ্টা থাকত একদিকে বিদ্যালয়ের সুনাম, আরেক দিকে শিক্ষর্থীদের প্রতি কঠোর নির্দেশনাও—বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে হলে ক্লাসের রুটিনমাফিক প্রত্যেক বিষয়-ক্লাস শিক্ষকের মুখামুখি হয়ে হাতের লেখা, মুখস্থ করা বাড়ির পড়া দিতে হবে।

সেকালে বেতের প্রচলন ছিল। পড়ালেখা না পরলে বেত দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করতেন শিক্ষকেরা। অভিভাবক এবং সরকারিভাবেও দক্ষ শিক্ষকের শাসন–বারণে বাধা ছিল না। এতে শিক্ষার্থীরা ডরে-ভয়ে শিক্ষা আহরণে থাকত দারুণ প্রতিযোগিতা, প্রাক্‌–নির্বাচনী পরীক্ষায় ফলও ভালো হতো। এভাবেই আমাদের কখনো বেলা-অবেলা স্কুলেই দিন কেটে যেত।

এ ছাড়া অভিভাবকদের আরেকটি কঠোর নির্দেশনা ছিল সকালবেলা—পাঁচ কলমা, নামাজ, রোজা, কোরাআন শিক্ষার জন্য সকালে মক্তবে যেতে হতো। আবার স্কুল ছেড়ে বাড়ি ফিরে তড়িঘড়ি খানা সেরে গোধূলিলগ্নে লোকসংস্কৃতির আধার খেলাধুলায় মেতে, কী সুন্দর দিন কাটাতাম। দিন গিয়ে যখন সন্ধ্যা নামে, তখন মা–বাবার নির্দেশ থাকত, কম হলেও রাত ১২টা পর্যন্ত পড়াশোনা করতে হবে। সেই কথা বুকে ধারণ করে, আমরা ভালো নম্বরও পেতাম। এতে গাঁয়ে যখন জোর আওয়াজ হতো, অভিভাবকেরাও অনেক খুশি হতো।

আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছার আগে গ্রামগুলো নিত্যান্তই নীরব ছিল। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই তেমন শিক্ষিত ছিল না, নিরক্ষর, আবেগপ্রবণ ছিল। যদিও নয়, লোকসংস্কৃতির অনুষঙ্গ কালভদ্রে বেতারতরঙ্গের বিনোদন ধরে নেওয়া যেতে পারে; কিন্তু সন্ধ্যা হলেই ছোট-বড়, বুড়োরা রেডিও নিয়ে অপেক্ষায় থাকত কখন বাজবে রাত ৭.৩০ মিনিট কিংবা ৮টা।

মজার বিষয় হলো, শীত মৌসুমে অলস মানুষেরা, তৎকালীন আকাশবাণীর ঢাকা কেন্দ্র থেকে কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান, সৈনিক ভাইদের অনুষ্ঠান দুর্বার, বিবিসির সংবাদ, ভয়েস অব আমেরিকার সন্ধ্যা অধিবেশন, সাধারণ জ্ঞানের আসর, অনুরোধের আসর গানের ডালি, সমুদ্রে জেলেদের নৌসংকেত, ক্রিকেট, ফুটবল খেলা, দুর্যোগের খবর হয়তো কারও কাছে আনন্দের আবার কারও না–ও হতে পারে। কিন্তু বিশেষ করে লাইলি–মজনু, গাজী–কালু–চম্পাবতী, শিরি–ফরহাদ, পুঁথিপাঠ, জারিসারি, কবিগান, মীর মশাররফ হোসেন মহাকাব্য ‘বিষাদ-সিন্ধু’ শুনে অনেক বর্ষীয়ানই খুশি হতেন, মাঝেমধ্যে চোখের জলও ফেলতেন, দেখেছিলাম।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রেডিওর ব্যাপক ভূমিকার কথা বলার উপেক্ষা রাখে না। সেই কালরাতে ঘরে ঘরে হাতেও শোভা পেত। এই বেতার তরঙ্গ রেডিও সেকালে বেশ জনপ্রিয় ছিল। দেশ-বিদেশের খবর, গান, পরিবেশবান্ধব নাটক, সিনেমা শোনার মাধ্যমও কম নয়, স্মৃতিচারণা হলে কারও মনে আঁচড় কাটে। সকাল হলে চায়ের দোকানে রেডিওর খবর শোনতে ভিড় জমাত। তখনকার সময়টা বেশ অন্য রকম লাগত। একালে কাজে ক্রমে সেই আড্ডা এখন আর চোখে পড়ে না।

আমাদের পরগনাটির নাম প্রাচীন শহর সোনারগাঁ। তথ্য-বিনোদনে লোকমুখে- বিয়ে, নানা অনুষ্ঠানে মাইক ও রেডিওর জনপ্রিয়তা জনমনে ভাটা পড়লেও নদীতীরবর্তী জেলে সম্প্রদায়ের হাতে এখনো তা দেখতে পাই। নিজ এলাকা ছাড়াও চলমান পরীক্ষার কথা বিবেচনা না করে বিয়ে কিংবা খতনাসহ নানা অনুষ্ঠানে জোর খাটিয়ে উচ্চ শব্দে ভিনদেশি, দেশীয় রোমান্টিক গান, বিরহের গান, কখনো দেশের গান, গভীর রাতে বোমার বিকট আওয়াজে আকাশ–বাতাস ভারী, পরীক্ষার্থী, রোগে আক্রান্ত মানুষকে নির্ঘুম রাতও কাটাতে হয়। দেখার কেউ আছে, নেই?
একসময় বিয়ে বা যেকোনো অনুষ্ঠানে এমনকি হোটেল, রেস্তোরাঁয় মাইক কিংবা সাউন্ড বক্সের উচ্চ ধ্বনির নিয়মনীতি পূর্বে বলবৎ থাকলেও বর্তমানে সেই ধারা এখন আর নেই।

১৯৯০ সাল থেকে ২০২১ সালে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা কত? হয়তো আমার জানা নেই। ক্রমান্বয়ে তা বাড়ছে আর সভ্য বিনোদন বর্তমানে পৃথিবীর ইতিহাসে ভার্চ্যুয়াল কুসংস্কৃতির প্রভাবে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।

মা–মাবা চাকরিক্ষেত্রে কখনো নানা কাজে দায়িত্ব পালনে যখন যান। তখন শিশু-কিশোরেও মা–বাবাকে বাধ্য করে মোবাইল দিয়ে যেতে হবে, তা না হলে শিশু-কিশোর নারাজ থাকে...কখন কি হয়, তখন অভিভাবকেরাও নত হন। আবার শিশুসন্তানদের খাবার খেতে চেষ্টা করলেও মোবাইল হাতে পেলে অনায়াসে খেতে দ্বিধাও করে না। এই ভার্চ্যুয়াল সমস্যা এক দিনে আক্রান্ত হয়নি। তাদের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে ধীরগতিতে মা–বাবা এবং আক্রান্ত ব্যক্তি, যাকে বেশি মান্য করে, তাকে দিয়ে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের কে যাহাতে ভার্চ্যুয়াল জগতে ঢুঁ মারতে না পারে, তা বন্ধ করতে হবে।