শিরোনামে বিভ্রান্তি

বিভ্রান্ত পাঠক
ছবি: ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

মর্নিং শোজ দ্য ডে—বহুল প্রচলিত একটি ইংরেজি প্রবাদ, যার ভাবার্থ, সকাল দেখেই নাকি বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে। পত্রিকার শিরোনামের সঙ্গে প্রবাদটির প্রতীকী মিল আছে। শিরোনাম দেখে কোনো বিষয় সম্পর্কে বেশ খানিকটা আঁচ করা যায়। একটা আদর্শ বা কার্যকর শিরোনামের সংজ্ঞা অনুযায়ী, এটি এমন হতে হবে, যাতে পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, পাঠক আগ্রহী হয় এবং বিষয়টি নিয়ে পাঠক মোটামুটি একটা ধারণা লাভ করে। তবে বাস্তবে সব সময় সবকিছু তো আর আমাদের প্রত্যাশামতো হয় না। সকালে হয়তো আলো–ঝলমলে একটা দিন দেখে ঘর থেকে বের হলেন; খানিক বাদেই দেখলেন আকাশের মুখভার আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বাঁধভাঙা কান্নায় সয়লাব চারপাশ। পত্রিকার শিরোনামের ক্ষেত্রেও এমনটা হয় কখনো কখনো। শিরোনাম দেখে আপনি হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না, ভেতরে কী অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্য! কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

কয়েক দিন আগে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম, ‘অধ্যক্ষের চেয়ার বানরের দখলে’। চমকে ওঠার মতোই শিরোনাম। আপনার মনের মধ্যে নিশ্চয়ই এতক্ষণে নানা ধরনের ভাবনা উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে। ভাবছেন, ব্যাপারখানা কী? অতি উৎসাহী কেউ কেউ হয়তো এটাকে প্রতীকী ধরে নিয়ে দেশে সম্প্রতি আলোচনায় আসা নামকরা এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের সঙ্গে এর যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। প্রকৃত ঘটনাটা হচ্ছে, ভারতের মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র শহরের একটি স্কুলের অধ্যক্ষের কক্ষ খালি ছিল। সেই সুযোগে সেখানে ঢুকে তাঁর চেয়ারে বসে বেশ আরাম করছিল একটি বানর।

একসময় বাংলাদেশের রেলসেবা কার্যক্রম দুই ভাগে বিভক্ত ছিল—যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে ছিল পশ্চিমাঞ্চল আর পূর্ব পাড়ে পূর্বাঞ্চল। ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু চালু হওয়ার আগপর্যন্ত এ দুই অঞ্চলের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ ছিল না। যমুনা সেতুর কল্যাণে এই দুই অঞ্চলের মধ্যে রেল সংযোগ স্থাপিত হয়। গাজীপুর থেকে টাঙ্গাইলের ওপর দিয়ে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হয়। এর আগে টাঙ্গাইল জেলায় কোনো রেলপথ ছিল না। যমুনা সেতুর উদ্বোধনের পর দেশের পূর্বাঞ্চল আর পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে চালু হয় সরাসরি রেলসেবা কার্যক্রম যা ছিল নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ নিয়ে পরের দিন একটি পত্রিকার শিরোনাম, ‘টাঙ্গাইলবাসী রেল দেখিলো!’ এ কথা সত্য এর আগে টাঙ্গাইল রেলসেবার আওতায় ছিল না, তাই বলে এ অঞ্চলের অধিবাসী কখনো রেল দেখেনি, এ কেমন কথা! মনে পড়ে খবরটি দেখে টাঙ্গাইলবাসী এক বড় ভাইয়ের রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে-অপমানে রক্তিম হয়ে যাওয়া মুখ!
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাকে নিয়ে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। শিরোনামটি ছিল, ‘স্ত্রীকে রাস্তায় ফেলে গেলেন স্বামী, কাছে টেনে নিলেন মাশরাফি’। এই শিরোনাম দেখে স্বয়ং মাশরাফি তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা ব্যক্ত করেন। আসল ঘটনা ছিল এ রকম—নড়াইলে অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে রাস্তায় ফেলে যান তাঁর স্বামী। মাশরাফির হস্তক্ষেপে ওই নারীকে তার স্বামীর বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়।

আরেক জনপ্রিয় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে নিয়ে করা একটি শিরোনাম, ‘হারের জন্য শিশিরকে দুষলেন সাকিব’। হেডলাইনটি দেখে অনেকেই হয়তো কিছুটা নড়েচড়ে বসেছেন, কেননা শিশির সাকিবের স্ত্রীর নাম। পরাজয়ের জন্য শিশির কীভাবে দায়ী? আসলে এই শিশির সেই শিশির নন! এই শিশির হচ্ছে মাঠের ওপর জলীয় বাষ্প জমা হয়ে সৃষ্ট জলকণা, যার সংস্পর্শে বল ভিজে যায়, ফলে বোলারদের বল গ্রিপ করতে কষ্ট হয়, ভীষণ অসুবিধা হয় বল করতে।

কাটার মাস্টার মোস্তাফিজকে নিয়ে একটা শিরোনাম ছিল, ‘এবার মুখোমুখি ট্রাম্প মোস্তাফিজ’। খবরটা দেখে ভিরমি খাবার জোগাড়! খ্যাপাটেপনার জন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিখ্যাত, তাই বলে মোস্তাফিজকে নিয়ে কী সমস্যা তাঁর? ভেতরের খবর—২০১৬ সালে নাকি বাংলাদেশ থেকে গুগলে সবচেয়ে অধিকসংখ্যক সার্চ দেওয়া ব্যক্তি ছিলেন ট্রাম্প আর দুইয়ে মোস্তাফিজ!

শিরোনাম নিয়ে বিভ্রান্তি যে কেবল আমাদের দেশে হয়, তা কিন্তু না; আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এ রকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় দৈনিকের শিরোনাম, ‘দুধের দামে ধস, চাকরি হারাচ্ছে গরু (Cows lose their jobs as milk prices drop)’। শিরোনাম দেখে আপনার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কী? ভাবছেন, হাসবেন না কাঁদবেন? জনৈক দুগ্ধ খামারির ১০০টি উন্নত জাতের গাভি ছিল। দুধের দাম কমে যাওয়ায় তাঁর পক্ষে গাভিগুলো পালন করা যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছিল। তিনি গাভিগুলোকে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ রকম অবস্থা হয় আরও অনেক খামারির। খামারিদের অসহায় অবস্থা বর্ণনা করতে সম্ভবত এ রকম একটি হেডলাইনের সৃষ্টি।

সংবাদপত্র পড়ছেন উৎসুক মানুষ
ছবি: ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

কিছু শিরোনাম দেখে আপনি হয়তো বলবেন, এটা কোনো কথা হলো? এ যেমন, ‘দরিদ্রদের আরও টাকার প্রয়োজন: বিশ্বব্যাংক’ (World bank says poor need more money)। টাকা নেই বলেই তো মানুষ দরিদ্র আর এ কারণে দরিদ্র মানুষের অধিক টাকার প্রয়োজন। এ শিরোনামের প্রেক্ষাপটটা ছিল এ রকম—ধনী দেশগুলোর এক সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক প্রস্তাব করে, দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি কল্পে আরও অধিক আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন। এ প্রস্তাবকেই হয়তো শিরোনামে সহজ করে উপস্থাপন করার একটা (ব্যর্থ) চেষ্টা করা হয়েছে। ‘সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’

এ রকম আরেকটি শিরোনাম, ‘ফেডারেল এজেন্টদের বন্দুকের দোকানে তল্লাশি, অস্ত্র উদ্ধার (Federal agents raid gun shop, find weapons)।’ বন্দুকের দোকানে তো অস্ত্র থাকার কথা, তাই না? এটা কোনো খবর হলো! বিষয়টা ছিল, কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে গোয়েন্দারা এক অস্ত্র ব্যবসায়ীর দোকানে তল্লাশি চালায় এবং সেখান থেকে উদ্ধার করে অবৈধ অস্ত্র।

কখনোবা কোনো শিরোনাম দেখে আপনি সত্যি সত্যি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাবেন। যেমন: ‘টাইগার উডস তাঁর নিজের বল দিয়ে খেলেন: নাইকি’ (Tiger Woods plays with his own balls, Nike says)। ভাবছেন টাইগার উডস কার বল দিয়ে খেলেন তা নিয়ে নাইকির এত মাথাব্যথা কেন? ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ জটিল ছিল। নাইকির গলফ বলের এক বিজ্ঞাপনে বলা হয়, টাইগার এই বল দিয়ে খেলেন। বিজ্ঞাপনটিকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয় এবং সেখানে প্রমাণিত হয় তিনি ওই বল দিয়ে খেলেন না, তিনি খেলেন তাঁর জন্য বিশেষভাবে বানানো বল দিয়ে। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নাইকিকে এ কথা জনসমক্ষে স্বীকার করতে হয়।

প্রতিটি ঘটনার অনেক ডাইমেনশন থাকে। সবাই সব সময় ঘটনার সবদিক দেখতে পায় না। স্বাভাবিকভাবেই একই ঘটনার শিরোনাম একেক সংবাদমাধ্যমে একেক রকমের হয়। এ সম্পর্কে পুরোনো একটি গল্প দিয়ে শেষ করি। সীমান্ত এলাকায় একটি গরুর শিঙের গুঁতোয় একজন তরুণী আহত। এ ঘটনা নিয়ে তিনটি পত্রিকার শিরোনাম: ১) দেশে ‘ম্যাড কাউ’ রোগের প্রাদুর্ভাব; পাগলা গরুর আঘাতে মারাত্মক আহত তরুণী; ২) সীমান্তে চাপা কান্না; নির্বিকার সীমান্তরক্ষী বাহিনী; ৩) ভারতীয় গরুর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশের তরুণী।


*লেখক: সাজ্জাদুল হাসান, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত।