শিক্ষায় বরাদ্দ করা অর্থ দিয়েই শিক্ষাকে বিকল্পধারায় সচল রাখুন
এ বছরের বেশির ভাগ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে, তা–ও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থা স্থবির হয়ে আছে। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখলেও তা নামমাত্র। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ প্রাইভেট বা বাসায় পড়ে কোনো রকম মন্দের ভালোর মতো দায়সারা গোছের পড়াশোনা করছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা অলসভাবে নানা অকাজে সময় অতিবাহিত করছে। যেমন সারা দিন মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকা, অহেতুক ফেসবুকে সময় নষ্ট করা, ভিডিও গেম খেলা, সারা দিন এদিক–সেদিক ঘুরাঘুরি করা, আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করা ইত্যাদি। কথাটা অপ্রিয় হলেও সত্য যে স্কুল-কলেজের কিছু ছেলে মাদকের মতো ভয়াবহ নেশার জগতেও ডুব দিয়েছে। কথায় আছে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। শিক্ষাব্যস্থার বেহাল অবস্থার দরুন ছেলেমেয়েদের মধ্যে পারিবারিক, সামাজিক বন্ধনের সর্বক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের দেশ ও জাতি এতটা উন্নত হয়নি যে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর বিকল্প কোনো কর্ম বা বিনোদনমূলক শিখনের মাধ্যমে ব্যস্ত রাখবে। অথবা আমাদের অর্থনীতির ভিত এতটা মজবুত নয় যে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই উদ্যোক্তা হবে বা খণ্ডকালীন কর্মের সন্ধান করে নেবে।
এখন কথা হলো এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কী হতে পারত? শিক্ষার উন্নয়নে অনেক কাজই করা যেত শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার জন্য। শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার নানা পথ আমাদের ছিল বা এখনো আছে। এ জন্য আমাদের প্রথমেই যে বিষয়ে আলোকপাত করতে হবে, তা হলো শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা অর্থ। ২০১৯-২০২০ ও ২০২১-২০২১ শিক্ষাবর্ষে বরাদ্দ করা যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ ছিল তার সম্পূর্ণ অর্থ কিন্তু আমাদের ব্যয় হয়নি। উক্ত অর্থবছরে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যয় করা খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়ের অন্যান্য খাতের অর্থ খরচ হয়নি, যেমন স্কুল পরিচালনা বাবদ ব্যয় (খাতা-কলম ও অফিস স্টেশনারি), পরীক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয়, প্রশিক্ষণ ব্যয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভ্রমণ ব্যয়, বিভিন্ন দিবস উদযাপন ও জাতীয় অনুষ্ঠান উদযাপন ব্যয় ইত্যাদি।
যে পরিমাণ অর্থ আমাদের ব্যয় হয়নি, সে পরিমাণ অর্থ দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিকল্পভাবে কিছুটা হলেও চালু রাখা যেত। যাদের ফোন নেই, তাদের মোবাইল ফোন দেওয়া যেত। সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অর্থ সরকার বহন করবে এমনটা নয়। সরকার দেবে অর্ধেক আর বাকি অর্ধেক অর্থ শিক্ষার্থীর অভিভাবক ব্যবস্থা করবেন। আর সরকারিভাবে ইন্টারনেটের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। সরকারিভাবে যদি ইন্টারনেট সরবরাহ নিশ্চিত করা যেত, তবে আমাদের দেশ অনেক দিক থেকে লাভবান হতো। একদিকে সারা দেশের ইন্টারনেটের ব্যবস্থা নিশ্চিত হতো, অন্যদিকে বেসরকারি সেবা দাতা মোবাইল অপারেটরগুলো তাদের সেবার মান আরও সহজলভ্য করত। যাদের স্মার্টফোন নেই, তাদের যদি একটা করে মোবাইল দেওয়া যায়, তবে দেশের সার্বিকভাবে উন্নয়ন সাধিত হতো।
ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হলোই। এখনো সময় আছে শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে বিকল্পভাবে কাজ করার। আর কত দিন এভাবে শিক্ষা বন্ধ রেখে আমরা চলব? আর কত দিন আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বসে থাকবে? এভাবে আমরা নীরব স্রোতা হয়ে বসে থাকতে পারি না। এভাবে নীরব হয়ে বসে থাকলে তা ভবিষ্যতে নীরব ঘাতক মরণব্যধিতে পরিণত হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে সচল ও পুনরুদ্ধারে আরও অনেক পদ্ধতিগত ব্যবস্থা আমাদেরকে নিতে হবে। প্রয়োজনে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের সঙ্গে আলোচনা করে সঠিক পথ নির্ধারণ করতে হবে। তা–ও আর একদিনও বসে থাকা যাবে না। এভাবে চলতে থাকলে আমরা জাতিগতভাবে উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে পারব না। শিক্ষার মতো এত বড় ও বিরাট খাতকে অবহেলার চোখে দেখা ঠিক নয়। শিক্ষা খাত স্থবির মানে শিক্ষার সঙ্গে অন্য সব খাতই স্থবির হয়ে আছে। শিক্ষার সঙ্গে অর্থনীতির একটা বিশাল সম্পর্ক রয়েছে। এ অবস্থায় কর্তাব্যক্তিদের উচিত শিক্ষা নিয়ে গতানুগতিক ভাবনা থেকে বের হয়ে এসে আরেকটু সৃজনশীল ধারণা নিয়ে কাজ করা। দয়া করে কুম্ভকর্ণের মতো না ঘুমিয়ে একটু নড়েচড়ে বসুন।
লেখক: মো. মাহাবুবুর রহমান