ভ্যাক্সিন ন্যাশনালিজম ও এর থেকে মুক্তির উপায়
গোটা দুনিয়া আজ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। ওয়ার্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্যানুসারে ৬ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিট পর্যন্ত পৃথিবীতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৪২ লাখ ৬৫ হাজার ৯০৩ জন এবং শনাক্ত হয়েছেন ২০ কোটি ৮৪ হাজার ১৮০ জন। গত মাসের (১৯-২৫ জুলাই) পৃথিবীতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ, যা আগের এক সপ্তাহের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি, সেই সঙ্গে আক্রান্তের চেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। সুতরাং, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্যানুসারে, আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা গত দুই সপ্তাহের মধ্যেই ২০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এই মৃত্যুর মিছিল যেন থামার নয়, বৃদ্ধিই যেন এর নিয়ম।
করোনা মহামারিতে গোটা দুনিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ ছাড়িয়ে গেলেও থেমে নেই মহামারি থেকে মুক্তি পেতে উদ্ভাবিত টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী রাজনীতি। শুরু হয়ে গেছে জটিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশ। মূলত টিকার রাজনীতি শুরু হয়েছে টিকা বাজারে আসার আগেই। টিকাকেন্দ্রিক এই নগ্ন রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজম হিসেবে। মূলত ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজম হলো ভ্যাক্সিন বা টিকাকেন্দ্রিক এমন এক জাতীয়তাবাদ, যা অন্য জাতিরাষ্ট্রের সংকট ডেকে আনে। এটা রাজনীতির এমন একটি পর্যায়, যেখানে রাজনীতি শুরুই হয় মহামারিকে কেন্দ্র করে। মূলত মহামারির সময় ধনী রাষ্ট্রগুলো যখন নিজ দেশের জনগণের নামে টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রদত্ত চুক্তির বিনিময়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টিকা মজুত করে থাকে, তখন তাকে ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজম বলে। দাবি করা হয়, ধনী রাষ্ট্রগুলো টিকা বাজারে আসার আগেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এই চুক্তি করে থাকে।
পশ্চিমের ধনী দেশগুলোর প্রয়োজনের অধিক টিকার মজুতের ফলে তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে দেখা দিয়েছে টিকার চরম সংকট। ডিউক ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথ ইনোভেশনের সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে, উচ্চ আয়ের দেশগুলো ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন টিকার মজুত করেছে, সে তুলনায় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে মজুত হয়েছে মাত্র ৬৭০ মিলিয়ন। গ্রেট ব্রিটেন ফেব্রুয়ারির শুরু পর্যন্ত যে টিকা সংরক্ষণ করছে, সেটা তার জনসংখ্যার ছয় গুণ। একইভাবে কানাডার সংরক্ষিত টিকার পরিমাণ ৩৬২ মিলিয়ন, যা তার জনসংখ্যার ৯ গুণ (www.globalcitizen.org)। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাউটলেজের গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, ইউনাইটেড কিংডম, ইউনাইটেড স্টেটস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যা দুনিয়ার মোট জনসংখ্যার তুলনায় মাত্র ১৪ শতাংশ, এসব দেশ টিকা উৎপাদন ও ‘অ্যাডভান্স মার্কেট কমিটমেন্টস’–এর আওতায় তাদের জনসংখ্যার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি টিকা মজুত করেছে। অন্যদিকে আফ্রিকার দেশগুলো অর্থের অভাবে টিকার কার্যক্রম শুরুই করতে পারেনি (ফোরাম ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ–২০২১)। পৃথিবীব্যাপী মহামারি চলাকালে পশ্চিমাদের এ নগ্ননীতির ফলে সমগ্র তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে দেখা দিয়েছে টিকার সংকট। পশ্চিমা দেশের মতো চীন ও রাশিয়াও পাল্লা দিয়ে এই কাতারে নাম লিখিয়েছে। ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জটিল ভূরাজনীতি। গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে টিকার এমন সংকট দেখা দিয়েছে যে অগ্রিম টাকা দিয়েও টিকা পাওয়া যাচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মাইকেল রিয়ান পশ্চিমা দেশগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘we all need to ask ourselves, “would I have the vaccine if I thought it meant a health worker in the south wouldn’t get vaccine today?” We all need to examine our own consciousness, then tell our leaders what we them to do.’ অর্থাৎ, গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে যেখানে একজন স্বাস্থ্যকর্মী টিকা পাচ্ছেন না, সেখানে একটি দেশ তার ৯–৬ গুণ কিংবা ৯ গুণ টিকা সংরক্ষণ করছে। তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলো টিকা ক্রয় করতে প্রধানত দুটি সমস্যায় পড়ছে। একটি আর্থিক, অন্যটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় সবই পশ্চিম দুনিয়ার। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সবই পশ্চিম দুনিয়ার হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোই বাধ্য হচ্ছে নিজ দেশে টিকার চালানের অগ্রিম চুক্তিতে। কলোনিয়াল ঐতিহ্য এই ব্যবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী। ঔপনিবেশীকরণের পর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, আইএফআইসির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর স্বার্থই রক্ষা করে চলছে। এ ব্যবস্থাকে বলে নয়া উপনিবেশবাদ। ঘানার সাবেক প্রেসিডেন্ট কাওয়ামে নক্রুমা বলেছেন, আফ্রিকাকে এক হাতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, অন্য হাত থেকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এটাকে কোনো স্বাধীনতা বলে না, বরং এটি হলো উপনিবেশের নতুন পর্যায়। কারণ, স্বাধীনতার পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে পুঁজি, বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। যতটুকু গড়ে উঠেছে, তা অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতির কারণে দাঁড়াতে পারছে না।
ভ্যাক্সিন ন্যাশনালিজম থেকে মুক্তির উপায় কী
ভ্যাক্সিন ন্যাশনালিজম হলো একধরনের লৌহজাল, যা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সৃষ্টি। তৃতীয় দুনিয়ার দেশ হিসেবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। তবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না, বিষয়টি এমন নয়। তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে প্রধান সমস্যা হলো, এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। শিক্ষাতে বিনিয়োগ কম হওয়ায় এখানে বিশেষজ্ঞ ও নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে না। মূলত উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা না থাকায় এখানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। এ কারণের পেছনে কাজ করছে প্রধানত দুটি কারণ। প্রথমত, আরবান এলিট ক্লাসের সন্তানেরা এখানে পাবলিক বা দেশীয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ছে না। দ্বিতীয়ত, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উন্নত শিক্ষা না থাকায় রাজনীতিতে অন্য পেশার মানুষ, বিশেষত ব্যবসায়ী, এককালের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আধিপত্য চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে না। মূলত আশির দশকের পর থেকে তৈরি পোশাকশিল্পকে কেন্দ্র করে পুঁজির বিকাশ, যা বর্তমানে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ (https://www.bgmea.com.bd/)। পাশাপাশি অন্য শিল্পের বিকাশে তৈরি হয়েছে আরবান এলিট ক্লাসের। পাশাপাশি অনেক বিত্তশালী রাজনীতিবিদ এবং বিভিন্ন পদে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সন্তানেরাও দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, বিশেষত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচলিত রাজনীতির কারণে অনিরাপদ পরিবেশ ও পশ্চিমা দুনিয়ার তুলনায় শিক্ষার মানের বিবেচনায় এখানে পড়তে চায় না।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সন্তানেরাও যোগ দিয়েছেন এই কাতারে। আমাদের এসব সন্তান দেশে চলমান ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে প্রধানত উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছে। একপর্যায়ে দেশের জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যাচ্ছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও একই অবস্থা, মানের বিবেচনায় সরকারি হাসপাতালে এলিট ক্লাসের কেউ সেবা নিতে আসেন না। এমনকি রাজনীতিবিদ, যাঁরা জনপ্রতিনিধি, তাঁরাও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, বিদেশ–নির্ভরতা কখনো ভ্যাক্সিন ন্যাশনালিজম কিংবা যেকোনো জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা করতে সক্ষম না। এ জন্য প্রয়োজন দেশীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ তৈরি, যাঁদের চেতনায় থাকে জাতীয়তাবাদ বা স্বদেশপ্রীতি। ভ্যাক্সিন ন্যাশনালিজমের মোকাবিলায় ইরান উত্তম উদাহরণ হতে পারে। সম্প্রতি ইরান ভ্যাক্সিন ন্যাশনালিজম থেকে মুক্তি পেতে তারা দেশীয় পুঁজি, প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগিয়ে COVIran Barekat নামে কোভিড ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে। এই টিকার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে প্রথম ডোজ নিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ৮২ বছর বয়সী আলী হোসাইনি খোমেনি। আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলোকে দ্রুত সরকারিভাবে সহযোগিতাসহ প্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের তথ্যানুসারে, করোনাভাইরাস ২০২৪ সাল পর্যন্ত থাকবে। এটি নিশ্চিত কোনো গবেষণা না। মূলত কত দিন এই ভাইরাস থাকবে, তা সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত না।
পরিশেষে বলতে চাই, এটা ভুলে গেলে চলবে না, বঙ্গবন্ধু মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রে যার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বলবৎ রাখবার জন্য বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র রূপে ঘোষণা করছি’ (ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯০৫-১৯৭১)। মূলত এটিই মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা, যাতে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হলে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার পূর্বশর্ত নাগরিকদের উন্নত শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সমাজে বেঁচে থাকার সব অধিকারের সমান সুযোগ–সুবিধা প্রদান। আর বিদেশ–নির্ভরতা কিংবা জাতীয় দুর্যোগে ভ্যাক্সিন ন্যাশনালিজমের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য স্বনির্ভর দেশের জুড়ি নেই।
*মো. শফিকুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়