বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, বাংলাদেশের করণীয় কি
নিত্যপণ্যের বর্তমান দামের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সব স্তরের মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে। চাল-ডাল-তেল থেকে শুরু করে অতি প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দামের একই অবস্থা। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্য মতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১০৪ টাকা। যার বর্তমান দাম ১৭০ টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে গড়ে চালের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ১৫ টাকা, ডাল ২০ টাকা। ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার ২০১৯ সালে ছিল ৮৫০ টাকা; বর্তমান দাম ১৩৯১ টাকা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতি দুজন মানুষের একজনের আয় কমেছে। এদিকে মূল্যস্ফীতি প্রভাবে করোনাকালীন বাংলাদেশের অর্জনগুলো ম্লান হতে বসেছে। ২০২০ করোনা মহামারির মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করা তিন দেশের একটি ছিল বাংলাদেশ। করোনার ধাক্কা অন্যান্য দেশ থেকে অনেক দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করার পরেও এ সময়ে দারিদ্র্যের হার করোনাপূর্ব ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশ হয়েছে। বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে কিছু সময়ের জন্য হলেও বেকার থাকতে হয়েছে। আবার কাজ কাজ করলেও ৬৩ শতাংশের আয় কমেছে।
তবে, বাস্তব সত্য হলো, মূল্যস্ফীতির এই চিত্র শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয় বরং এটি এখন বৈশ্বিক সমস্যা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা এফএও এর জরিপ মতে, ২০১১ সালের পর বিশ্বব্যাপী বর্তমানে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। গত দুই বছরের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ।
আইপিএসওএস এর জরিপ মতে গত ছয় মাসের ব্যবধানে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়েছে গড়ে ৫৯ %, যার সর্বোচ্চ আর্জেন্টিনায় ৭৯ %। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় ৭৩ %, ভারতের ৫৮% আমেরিকায় ৫৬% চিনে ৩৫% মূল্যস্ফীতি ঘটেছে।
বিশ্বব্যাপী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। শুরু করা যাক সাপ্লাই চেইন দিয়ে। সাপ্লাই চেইনকে উৎপাদন, বণ্টন, পরিবহন এবং খুচরা বিক্রি-এই ৪ ধাপের সমন্বয় বলা যেতে পারে। বর্তমানে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে বড় ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, যার অন্যতম কারণ করো না মহামারি। দেশে দেশে লকডাউন তুলে নিতে শুরু করায় বিভিন্ন জিনিসের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেছে-সৃষ্টি হচ্ছে পরিবহন সংকট। সাপ্লাই চেইন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে যারা জড়িত ছিলেন, করোনা মহামারিতে তাদের অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, অনেককে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, পেশাও পরিবর্তন করেছেন অনেকে। আবার বিদেশি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে অনেকে দেশে ফিরে এসেছেন। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার পাম ওয়েল ইন্ডাস্ট্রির কথা বলা যেতে পারে, যেখানে গত এক বছর যাবৎ শ্রমিক সংকটের কারণে উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্বজোড়া শ্রম সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তীব্র জ্বালানি সংকট। কৃষিতে ব্যবহৃত সার প্রধানত নাইট্রোজেন এবং অ্যামোনিয়া থেকে তৈরি হয়, যা পাওয়া যায় প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। বিশ্বব্যাপী তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সাপ্লাই চেইন এর প্রতিটি ধাপই এতে প্রভাবিত হচ্ছে। করোনায় চাহিদা ও দাম কমে যাওয়ায় ২০২০ সালের মে মাসে ওপেকভুক্ত দেশগুলো দিনপ্রতি এক কোটি ব্যারেল তেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। করোনা-পরবর্তী সময়ে কল-কারখানা খুলতে শুরু করায় জ্বালানি তেলের দ্রুত চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সুযোগ কাজে লাগাতে ওপেকভুক্ত দেশগুলো চাহিদামতো তেল উৎপাদন বাড়াচ্ছে না। ইকুয়েডর, কাজাখস্তান এবং লিবিয়ার মতো দেশগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তেলের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো লাভবান হলেও ভোক্তা দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। তেলের দরে লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্র-চীনসহ শীর্ষ ভোক্তা দেশগুলো গত বছরের শেষ দিকে মজুত থেকে জ্বালানি তেল বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এত কিছুর পরও নানা কারণে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। নতুন বছরে এ পর্যন্ত অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দর ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৪০ ডলার, যা ২০২২ সালের শুরুতে ৯০ ডলারে পৌঁছায়। ইউক্রেনে রুশ সামরিক তৎপরতার পর এই দাম ১১৮ ডলার ছুঁয়েছে।
এর পাশাপাশি খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্য উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। আইপিসিসির তথ্য মতে, চলতি বছর শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশেষ কিছু অঞ্চলে খাদ্যদ্রব্যের দাম ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে গেল বছর উত্তর আমেরিকায় গম উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। একই অবস্থা ছিল দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়েতে। দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে এই বিষয়গুলোও।
এ ছাড়াও আমদানিতে অতিরিক্ত ট্যাক্স, ব্যবসায়ীদের কারসাজি, আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রার দাম কমে যাওয়া, বাজার নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদক্ষেপের অভাব সহ নানা কারণে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে দ্রব্য মূল্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ: করণীয় কী?
জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাবে ইতিমধ্যে দেশে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে চোখ রাঙাতে শুরু করেছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ। পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বে শিগগিরই আসছে রোজা। এই পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের জন্য আশু চ্যালেঞ্জ। সরকারের কাছে বাজার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার মূলত চারটি-১. পণ্যের ওপর শুল্ক-কর কমানো, ২. খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়ানো, ৩. বাজার তদারকি জোরদার করা, এবং ৪. বার্ষিক কী পরিমাণ চাল ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে হবে তার সঠিক হিসাব নিরূপণ করে আমদানির ব্যবস্থা করা।
মনে রাখতে হবে, যে কারণে পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া, তার অনেকটা দায় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির। বাস্তবতা হলো, বিশ্ব বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম কিছুটা বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে পণ্যটির ওপর আরোপিত প্রায় ৩৪ শতাংশ কর কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহে অনিয়ম, অবৈধ মজুত, দুর্নীতি ও অপচয় কমিয়ে সাশ্রয়ী হওয়ার দিকেও মন দেওয়া উচিত।
মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব রাতারাতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তবে বছরের সামনের দিনগুলোতে বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলতে না পারে, সে লক্ষ্যে এখনই পরিকল্পিতভাবে আগাতে হবে বাংলাদেশকে। সরকারি হিসেবে, ২০২০ সালের ৩ দফা বন্যায় বাংলাদেশের ১.৫ লাখ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি এবং করোনা প্রভাব থেকে উত্তরণের এই বছরে এমন দুর্যোগ গভীর মানবিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বরাবরের মতো একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ইস্যু। করোনাকালে সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে, মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে তা সকল শ্রেণির মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনবে না; উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত থেকে যেতে পারে নিম্ন আয়ের মানুষ। এমন বাস্তবতায়, বাজার নিয়ন্ত্রণে জরুরি ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। আর সেটি করতে না পারলে নতুন বছরে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে। রুখে দিতে হবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সকল অপচেষ্টা।