প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে দল বেঁধে শিশু-কিশোরেরা জমা হয় খেলার মাঠে। বাহারি রঙের জার্সি পরা খুদে ফুটবলাররা, সারি সারি ফুটবল সাজানো মাঠে। প্রথমে পিটি করানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুশীলনের কার্যক্রম। ছোট, মধ্যম ও বড় গ্রুপ ভাগ করে দেওয়া হয় শিশুদের মধ্যে। প্রতি গ্রুপে আবার আলাদা শারীরিক ব্যায়াম শেষে নিজেদের মধ্যে ম্যাচের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে সহজেই প্রশিক্ষক বিপ্লব বুঝতে পারেন শিশুদের খেলার মান সম্পর্কে, তাদের সম্পর্কে, তাদের স্ট্যামিনাসহ মানসিক বিকাশ সম্পর্কে। ইতিমধ্যেই ছোট ও মধ্যম গ্রুপের শিশু–কিশোরেরা উপজেলার বিভিন্ন স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্টসহ প্রীতি ম্যাচে বিজয়ী হয়ে সুনাম কুড়িয়েছে বিপ্লবের খুদে ফুটবলাররা।
করোনাকালীন দুর্যোগ মোকাবিলা এবং করোনা মহামারির কারণে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এক বছর হয়ে গেল। এর একটি বিরূপ প্রভাব পড়েছে শহরের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদের, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুদের ওপর। সংসদ টিভি, অনলাইন, রেডিও ও মুঠোফোনের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দূরশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও বাস্তবে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই এ ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারেনি বলে এমন তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণায়। করোনাকালীন সময়ে শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল ও শহরের বহু শিক্ষার্থী পড়াশোনার স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়েছে। দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থাকায় অনেক শিশুর মানসিক বিকাশেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তাই এ দুর্বিষহ অবস্থা থেকে শিশুদের মানসিক বিকাশসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দ্রুত অভিভাবকদের শিশুদের ঘরে–বাইরে সময় দেওয়ার পাশাপাশি তাদের বিনোদনের নানা ব্যবস্থা করে দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
শিশুদের মুঠোফোন আসক্তি ও মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে বিপ্লব ফুটবল খেলাকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে শিশুদের নিয়ে নিয়মিত অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর ক্যাম্পে। বিপ্লবের অনুশীলন ক্যাম্পে নিজের দুই সন্তানকে নিয়ে আসা অভিবাবক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমার দুই সন্তান। কয়েক মাস আগে মারা যায় আমার স্ত্রী। সন্তানেরা কার্টুন দেখা ছাড়া কিছু বুঝত না। শেষ পর্যন্ত বিপ্লব ভাইয়ের এ প্রশিক্ষণে দুই ছেলেকে আনার পর এখন আর তারা মোবাইলের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায় না। আমার শিশু এখন নিয়মিত খেলাধুলা করে। তারা খুব ভালো আছে। বিপ্লব ভাইয়ের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
তবে বিপ্লবের এ উদ্যোগকে শুরু থেকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং সব সময় পাশে থেকে অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা করেছেন বিপ্লবের খেলার বন্ধু উপজেলার বাক্তা ইউনিয়নের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক। তিনি বলেন, ‘বিপ্লব আমার বন্ধু। একসঙ্গে খেলাধুলা করেছি ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলায়। সে চাকরি শেষে বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলা ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শিশুদের মোবাইল ফোন এবং মাদক থেকে দূরে রাখার জন্য তার উদ্যোগ অনন্য। বিনা খরচে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, এটা দেখে আমি অভিভূত। এখানে টাকাপয়সা ছাড়াই বন্ধু বিপ্লব শিশু–কিশোরদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। এমন উদ্যোগকে সামনের দিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে আমি চেয়ারম্যান হিসেবে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছি এবং আমি বিশ্বাস করি, এ উপজেলায় আবার ফুটবল খেলার আগের সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনবে এ কোমলমতি শিশু–কিশোরেরা।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, দীর্ঘদিন লেখাপড়া থেকে দূরে থাকায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম বাড়ছে। দীর্ঘদিন পড়াশোনার বাইরে থাকায়, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অসংখ্য শিক্ষার্থী পড়াশোনা বাদ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া মাদকের ভয়াল থাবা তাদের গ্রাস করে নিচ্ছে। বর্তমানে শিশুদের খেলার জন্য কমে যাচ্ছে মাঠ ও বিনোদনের মাধ্যমগুলো। তাই সেনাবাহিনীর এই অবসর কর্মকর্তা বিপ্লবের মতো উদ্যোগী মানুষগুলো দেশে যদি শিশুদের জন্য এভাবে এগিয়ে আসে এবং সরকারি-বেসরকারিভাবে মানুষগুলোকে যদি সহযোগিতা করে, তাহলে একদিকে খেলাধুলার যেমন প্রসার বাড়বে, তেমনি আজকের শিশুরা পাবে আগামীর সুস্থ–সুন্দর একটি পৃথিবীর ঠিকানা।