বিদায়, বুয়েট!
হলের করিডরের ঠিক শেষ মাথায় একটা বন্ধ জানালা, আমি ঠিক সেদিকেই হাঁটছি। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, জানালার শিক গলে রোদ এসে জায়গাটা হলুদাভ করে রেখেছে।
হাঁটার মধ্যে রাজ্যের চিন্তা মাথায় বাসা বাঁধে। মনে পড়ে, কার সঙ্গে কখন কীভাবে পরিচয়, তখন কী ভাবতাম আর এখন কী ভাবি, এটা নাহলে কী হতো ইত্যাদি। কোনো কারণ ছাড়া ভাবনা। হাঁটার মাঝে থামি, আবার ভাবি।
ঠিক পাঁচ বছর আগের এই দিনে ইসিই ভবনে প্রবেশ করি। আজ পাঁচ বছর পর মূল ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। এই তো। অনেক বড় আশা নিয়ে ভর্তি হইনি, আজ তাই আক্ষেপের আলাপটা বাদই থাকুক। বরং অন্য কিছু ভাবা যাক।
মনের চোখ দিয়ে তখন রাতের নীরব ক্যাম্পাসের হাফওয়ালে বসে একাকী রাস্তাটার দিকে তাকাই। দেখতে পাই, সিভিল ড্রয়িং করার উদ্দেশ্যে পিঠে ‘মিসাইল’ (সিভিল ড্রয়িংয়ের আঁকাআঁকির জন্য সরঞ্জাম) নিয়ে ১৯ বছরের আমি ঘুম ঘুম চোখে বুয়েট বাস থেকে নামছি, আর ধীর পায়ে ইসিইর দিকে রওনা দিচ্ছি। হাফওয়ালের দিকে লোভনীয় চাহনিটাও যেন পরিষ্কার দেখতে পাই। কারণ, ওখানে বসার অধিকার তখনো পাইনি যে!
খানিকটা ডানে তাকালে আবার ২০ বছরের আমাকে দেখি দৌড়ে দৌড়ে ওএবিতে ফিজিকস ল্যাবের দিকে যেতে। ইসিইতে ১০টা ৫০ মিনিটের ক্লাস ১১টায় শেষ হয় আর ১১টাতেই ওএবিতে ল্যাব শুরু। কী বিপদ!
এরপর মাথা ঘুরিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে তাকাই। এখানেই প্রথমবারের মতো সামনাসামনি অর্ণবের গান শুনছে ২০ বছরের আমি। সে কী রোমাঞ্চ! এরপর বিভিন্ন বয়সের আমাকে দেখি চিরকুট, ওয়ারফেজ, নগরবাউল ইত্যাদির গান শুনতে। কনসার্টে জীবনেও না যাওয়া আমাকে রাতবিরেতে গান শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে দেখতে বেশ লাগে।
একটু দূরে তাকালে আবার ২০ বছরের আমাকে ইউকসু ১০১-এ দেখি, যে কিনা গাধার মতো তীব্র শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে পাতলা চাদর জড়িয়ে নিয়ে কাঁপছে। অথচ তার মধ্যেও শুনছে ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া…’। কোনোমতে রাতটা কাটিয়ে সকালে উঠেই ক্যানটিনে গরম চায়ের জন্য দৌড়। কী যে দিন ছিল! এরপর ধীরে ধীরে এক্সটেনশন আর অবশেষে মূল ভবনে জায়গা করে নিতে দেখি ২১ বছরের আমাকে।
কখনো কখনো আবার বিভিন্ন আন্দোলনে রাস্তায় আর ক্যাম্পাসে মিছিলের এক কোনায়ও আবিষ্কার করে বসি নিজেকে। চোখটা বন্ধ করে বিভিন্ন বয়সের আমাকে দেখি হাফওয়ালে, আর্কির প্লিন্থে, ইসিইর মাঠে, ওএবির সিঁড়িতে, ক্যাফের বেঞ্চে—আরও কত জায়গায়! ছোট্ট এই ক্যাম্পাসের বুক যে এত প্রশস্ত ছিল, তা আগে কে জানত!
আমি নিশ্চিতভাবে বলতেও পারব না, কবে থেকে বুয়েটকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। ভালোবাসাটা হয়তো শুরু হয়েছিল ছোট কিছুর মাধ্যমে। হয়তো ভোর সোয়া সাতটার দিকে যখন বুয়েট বাসটা আধো ঘুমেও আশ্চর্য সতেজ থাকা বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢুকে হার্ডব্রেক কষে থেমে যায়, তখন সদ্য ঘুমভাঙা চোখে বাস থেকে নেমে চারদিক তাকিয়ে নিমেষে প্রাণ খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে ভালোবাসতে শুরু করেছি।
ভালোবাসাটা শুরু হতে পারে এক কাপ কফির মাধ্যমেও। পড়ন্ত বিকেলে ক্যাফেতে সবাই মিলে খাওয়া এক কাপ কফিও সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে পারে যে! কিংবা হয়তো র্যাগ কনসার্টের দিন! মধ্যরাতে কনসার্টের পর না ঘুমিয়ে সারা রাত রাস্তায় হাঁটা...আজীবন মনে রাখার মতো একটা দিন!
ভালোবাসার শুরুটা তারও আগে হয়তো শুরু হয়েছিল...পয়লা বৈশাখে? বুয়েটের সেই অসাধারণ রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েই হয়তো ক্যাম্পাসটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি? কিংবা রিসেপশন বা ইইই ডের জন্য রাতবিরেতে ইসিইতে পড়ে থাকার মাধ্যমেও ক্যাম্পাসটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কী জানি!
ভাবনা থামাই, আবার করিডরে ফিরে আসি। কী পেয়েছি আর কী পাইনি, সেসবের হিসাব বড্ড জটিল, আজ থাকুক। ক্লাস শেষ, শেষ প্রোগ্রামটাও শেষ। যে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে প্রথম ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছি, প্রথম মঞ্চে উঠেছি, প্রথম চিত্রনাট্য লিখেছি, প্রথম ট্যুরে গেছি, প্রথম রাতবিরেতে ক্যাম্পাসে পড়ে থেকে কাজ করেছি, আড্ডা দিয়েছি, রাজ্যের পাগলামি করেছি, তাদের সঙ্গে যে শেষ দিনটাও পার করতে পেরেছি, এটাই পরম পাওনা।
চাওয়া কেবল একটাই। ভালো থাকুক এই মানুষেরা, সুস্থ থাকুক এই ক্যাম্পাস। ভেবে আবার সামনে পা বাড়াই।
শেষ মাথার ওই জানালা ধীরে ধীরে বড় হয়, ফলে রোদটাকে আরও স্পষ্ট দেখার কথা। কিন্তু তা আর দেখা হলো কই? বরং চোখটা ঝাপসা হয়ে এল।
কোনো মানে হয়?
*লেখক: শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়