বাংলা নাটকে অশালীন সংলাপ, ইঙ্গিত ব্যবহার কি খুব দরকার

অনেকেই নাটক, সিনেমাকে বলে থাকেন সমাজের দর্পণ। যুগ যুগ ধরে মানুষের জীবনযাপন তথা সমাজের নানা দিক নাটক, সিনেমার মাধ্যমে দর্শকের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। নাটক বিনোদনের একটা বড় উৎস হিসেবে বহুকাল ধরে মানুষকে অনাবিল আনন্দ দিয়ে এসেছে। অনেক দিন আগে যাত্রা, অপেরা, পালাগান গ্রামের মানুষের বিনোদনের অন্যতম বড় কেন্দ্রবিন্দু ছিল। পরবর্তীকালে মঞ্চনাটকও মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও নাটকের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের টেলিভিশন চালু হওয়ার আগেও বেতারে প্রচারিত হতো বিভিন্ন নাটিকা, যা মানুষকে অবসর সময়ে আনন্দের খোরাক জোগাত। দেশে যখন টেলিভিশন চালু হলো, তখন থেকেই টিভি নাটকগুলো বিনোদনের অন্যতম উৎস হিসেবে মানুষকে আনন্দ দিয়ে আসছে। কিছু কিছু নাটক তো বিনোদনের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে মানুষের জীবন ও আবেগকে এমনভাবে তাড়িত করেছে যে মানুষও বাস্তবতার ঊর্ধ্বে গিয়ে নাটকের চরিত্রকে নিজেদের অতি আপন ভেবে নিয়েছিল। নাটকের সেই সব কিছু চরিত্রের অপ্রত্যাশিত পরিণতি  সাধারণ মানুষ অনেক সময় ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি।

৯০–এর দশকে স্বনামধন্য লেখক হুমায়ূন আহমেদ রচিত ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাই চরিত্রটি অন্যতম উদাহরণ। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি সেদিন দেশের মানুষের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির বিরুদ্ধে মিছিলও হয়েছিল। অনেক মানুষ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি মেনে নিতে পারেননি। এ রকম অনেক নাটকই সে সময় মানুষের আবেগকে এমনভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে যে মানুষ ক্ষণিকের জন্য হলেও নাটক ও বাস্তবতার মায়াজলে বন্দী হয়ে মনের অজান্তে বাকের ভাইয়ের জন্য চোখের জল ফেলেছে। সে সময়ের ‘আজ রোববার’, ‘রূপনগর’ ইত্যাদি নাটকের কথা মানুষ যুগ যুগ ধরে মনে রেখেছে। এর পরবর্তী সময়ে অনেক বাংলা নাটক মানুষের মনে বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে টেলিভিশনের সামনে বসে এসব নাটক উপভোগ করত।

সময়ের পরিবর্তনে নাটকের গল্প, পরিবেশ, চরিত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সঙ্গে এসেছে মিডিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলসহ, অ্যাপ, ইউটিউবে মানুষ এখন যেকোনো সময় নাটক দেখতে পারছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নাটকের গল্প, ইঙ্গিত, সংলাপেও যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, সেটা বর্তমান সময়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বর্তমান সময়ে কিছু কিছু নাটকে এখন এমন সংলাপ বা ইঙ্গিত ব্যবহার করা হচ্ছে, যেটা মা–বাবা, ভাই–বোন তথা পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে দেখার মতো পরিস্থিতি থাকছে না। অনেক ক্ষেত্রে নাটকে অশালীন শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অশালীন শব্দগুলো মিউট করে দিলেও তাঁর আগের ও পরের শব্দগুচ্ছ শুনে যেকোনো স্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষ সহজে সেটার প্রকৃত অর্থ বুঝে ফেলতে পারবে। এসব নাটক সাময়িকভাবে আমাদের যুবসমাজকে নিছক বিনোদন দিলেও গভীরভাবে চিন্তা করলে সেটা যে কোনোভাবেই বাংলা নাটকের জন্য সুদূরপ্রসারী কোনো সুফল বয়ে নিয়ে আসবে না, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব নাটকের মধ্যে অনেক নাটক জনপ্রিয়তা ও দর্শক ভিউয়ে ওপরের সারিতে অবস্থান করছে। সে জন্য কিছু কিছু পরিচালক এমন নাটক তৈরি অথবা নতুন গল্প তৈরি করে গল্পগুলোকে পর্ব আকারে বাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, যেটা আমাদের বাংলা নাটকের জন্য একটা বড় দুশ্চিন্তার কারণ।

আমরা অবশ্যই চাই, বাংলা নাটকগুলো সামনের দিনগুলোয়ও মানুষের বিনোদনের অন্যতম উৎস হয়ে থাকুক। তবে আমাদের এটাও নিশ্চিত করতে হবে যেন নাটকগুলো অবশ্যই সৃজনশীল ও শিক্ষণীয় হয়। তাই এসব পরিচালকের কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনারা এমন নাটক তৈরি করুন, যেটাতে কোনো অশালীন সংলাপ অথবা ইঙ্গিত থাকবে না, পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে দেখতে পারবে। না হলে সময়ের আবর্তে দেখা যাবে, শুধু একশ্রেণির দর্শককে সাময়িক বিনোদন দিতে গিয়ে মনের অজান্তে পুরো বাংলা নাটকই ধবংসের দিকে চলে যাচ্ছে!

*লেখক: প্রীতম মণ্ডল, ব্যাংক কর্মকর্তা।