বহুমাত্রিক সংকটে বাংলাদেশ

দুর্নীতি
প্রতীকী ছবি

আজ এই স্বাধীন দেশের সবাই কি ভালো আছে। নেই, ভালো নেই দেশের জনগণ। চারদিকে শুধু বহুমাত্রিক সংকট। নানান সংকটে ভুগছে সোনার বাংলা। সম্প্রতি আমাদের দেশে চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে; অর্থাৎ বলতে গেলে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে অধিক হারে।

বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। স্বল্প আয়ের মানুষগুলো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হিমশিম খাচ্ছে। বরং বলা যায়, তাদের জন্য বেঁচে থাকাটাই বড় চ্যালেঞ্জিংয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুমাত্রিক সংকটের বাংলাদেশে কেঁদে বাঁচে মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা। এ মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবার মতো কেউ নেই। এমনকি নিত্যপণ্যের দামের প্রতিবাদে রাস্তায় কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ নেই। যদিও করে থাকে, তাহলে চোখে পড়ার মতো নয়। এর অর্থ এই নয় যে তারা বিষয়গুলো সহজভাবে মেনে নিয়েছে। সামর্থ্য আছে বলেই কেনাকাটা করছে।

বিষয়টি মোটেও এ রকম নয়। আমরা যদি টিসিবির ট্রাকের দিকে লক্ষ করি, তাহলে দেখতে পাব অসহায় মানুষের দৌড় প্রতিযোগিতা। যেই প্রতিযোগিতা শুধু বেঁচে থাকার লড়াই করার প্রচেষ্টা। যেই প্রতিযোগিতা পেটের ক্ষুধা নিবারণের প্রচেষ্টা। তবু দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে টিসিবির পণ্য কেউ পাচ্ছে, আবার কেউ পাচ্ছে না। কারণ, টিসিবির পণ্যের তুলনায় মানুষের চাহিদা বেশি। দিন শেষে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বাঁচতে চায়। কিন্তু তাদের নেই কোনো ভরসা; বরং অসহায়ত্বই এখন তাদের নিত্যসঙ্গী।

কোথাও আলো নেই, নেই কোনো ভরসা। ভরসা তারা কোথায় পাবে? যে দেশের নীতিনির্ধারক মহল থেকে ‘বাংলাদেশের মানুষ বেশি ভাত খায় বলে চালের দাম বেড়ে গেছে ’, এমন যুক্তি শোনা যায়। নীতিনির্ধারক মহল শুধু এমন যুক্তি শুনিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি, বরং বলে, ‘চালের এত মূল্যবৃদ্ধির পরও দেশে কোনো হাহাকার নেই, আয় বেড়েছে বলে মানুষের কষ্ট হচ্ছে না।’ আমাদের দেশের নীতিনির্ধারক মহল এমন অদ্ভুত যুক্তিও বলতে দ্বিধাবোধ করেনি। দেশের নীতিনির্ধারক মহল মানুষের এমন অসহায়ত্বের সঙ্গে মশকরা করছে নাকি অন্য কিছু নিয়ে মাতামাতি করছে, এসব কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।

স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশের নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রতিনিয়ত দেশে নারী নির্যাতন ঘটেই চলছে। শিক্ষকের দ্বারা শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, এমন ঘটনাগুলো ঘটছে এই দেশে। ধর্ষণ, গুম-হত্যা এসব কিছু করা হচ্ছে অহরহ। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। একজন শিক্ষার্থী এ দেশের সম্পদ। পড়াশোনা শেষ করে এ দেশের নেতৃত্ব দেবেন। কেউ হবেন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষক, কেউ হবেন বড় কর্মকর্তা। সেই শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন! যা এই দেশের জন্য সত্যি হতাশাজনক এবং কলঙ্কজনক ঘটনা। গেল বছরের নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান যদি দেখি তাহলে দেখা যাবে, দেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১ হাজার ৩২১ জন নারী। দিন শেষে পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা তাদের জন্য নিরাপদ জীবন যাপন করার সুযোগ করে দিতে পারিনি।

এখনো দেশে নিরাপদ সড়কের সংকট। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। মায়ের বুক খালি হচ্ছে, পরিবারের খুঁটি ভেঙে যাচ্ছে। কোলের ছোট্ট শিশুটি পিতৃহারা অথবা মাতৃহারা হচ্ছে; অর্থাৎ বলতে গেলে একটি পরিবারের স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে, দেশের স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে। সড়কে স্বজনহারা পরিবারগুলো দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন ২০২১-এ বলা হয়েছে, ২০২১ সালে সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ৬ হাজার ২১৩টি দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫১৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৯ হাজার ৭৫১ জন। এ যদি হয় আমাদের দেশের সড়ক দুর্ঘটনার অবস্থা, তাহলে আমরা কীভাবে আর্থসামাজিক উন্নয়ন করব? কীভাবে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব?
বর্তমানে আমাদের দেশে সর্বস্তরে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিনিয়ত হচ্ছে দুর্নীতির ছড়াছড়ি।

দেশের এত এত সংকটের পরও আমাদের নীতিনৈতিকতা আজ ধ্বংসের মুখে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা নেই। নেই কোনো আন্তরিকতা। আছে শুধু একে অপরের প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণ। অথচ মানুষ সামাজিক জীব হয়েও অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত। এমনভাবে সুস্থ ধারার সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না। সুস্থ ধারার সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা থাকতে হবে, বিশ্বাস থাকতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় শুধু সমাজব্যবস্থাকে ঘিরে নয়; বরং এ দেশের শিক্ষক–সমাজব্যবস্থা ঘিরেই এখন প্রশ্ন ওঠে। জাতির উন্নয়ন বা মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকেরা যদি বিবেচিত হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের সব কর্মকাণ্ড হবে একটি জাতির পথপ্রদর্শক।

এ দেশে কৃষকদের মধ্যে রয়েছে একধরনের হাহাকারের প্রতিধ্বনি। তাঁরা তাঁদের ফসল উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য আদায় করতে পারছেন না। ভুলে গেলে চলবে না যে কৃষকেরাই এ দেশের মূল। তাঁদের উৎপাদিত ফসল থেকেই আমাদের বেঁচে থাকা। কিন্তু তবু কেন যেন তাঁরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার পান না। যা সত্যি বেদনার কথা।

পরিশেষে বলতে চাই, সরকারের নিজ নিজ কর্তৃপক্ষকে সংকট নিরসনে সোচ্চার হতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের নারী সমাজের সর্বস্তরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হলে অবশ্যই রাষ্ট্রের পাশাপাশি জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। সেই সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের নাম প্রকাশ করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। তাহলে পরবর্তী সময়ে কেউ এমন কাজ করতে সাহস পাবে না।
*লেখক: মু. সায়েম আহমাদ, শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা