বঙ্গবন্ধু: বাংলার জোছনা ও রোদ্দুর-৯

ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলার রাজনীতি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে মুসলমানরা প্রাদেশিক আইন পরিষদের চারটি মন্ত্রিসভা গঠন করে। ফজলুল হকের প্রথম মন্ত্রিসভা—১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে ১৯৪১ সালের ১ ডিসেম্বর। ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা—১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৩ সালের ২৯ মার্চ। খাজা নাজিমউদ্দিনের তৃতীয় মন্ত্রিসভা—১৯৪৩ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ১৯৪৫ সালের ৩১ মার্চ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা—১৯৪৬ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট।

ত্রিশের দশক থেকে হিন্দু-মুসলমানরা বিভিন্ন সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ সংঘাত যেন থামে না। ব্রিটিশ সরকারও নানাভাবে চেষ্টা করে এটা বন্ধ করতে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেটা ছিল ১৯৩৫ সাল। এ সময় ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসন আইন করে। অবশেষে এ আইন বিভিন্ন পক্ষের দ্বন্দ্ব নিরসনে কিছুটা ভূমিকা রাখে। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়। এর ফলে ১৯৩৭ সালে প্রথম অবিভক্ত বাংলায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে খাজা নাজিমউদ্দিনের মুসলিম লীগ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি ও কংগ্রেসের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়।

এর মধ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতের জাতীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক দল। আর কৃষক প্রজা পার্টি হলো প্রাদেশিক পর্যায় গঠিত বাংলার একটি রাজনৈতিক দল। ১৯২৯ সালে স্যার আবদুর রহিম নিখিল প্রজা সমিতি গঠন করেন। ১৯৩৫ সালে ফজলুল হক এ দলের সভাপতি হন। ১৯৩৬ সালে প্রজা সমিতির নতুন নামকরণ করা হয় কৃষক প্রজা পার্টি। বাংলায়, বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় দলটি ছিল দারুণ জনপ্রিয়। এ দলের ভাবনা ছিল কৃষক ও দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন। ১৯৩৭ সালের মার্চে নির্বাচন হয়। বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে মোট আসন ছিল ২৫০টি। এর মধ্যে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ১২১টি। নির্বাচনে বাংলার মানুষ প্রধান দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে অসাম্প্রদায়িক কৃষক প্রজা পার্টি ও অন্যদিকে অভিজাত ও মধ্যবিত্তদের মুসলিম লীগ। তিনটি দলের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ফজলুল হকের দল পায় ৩৮টি আসন। মুসলিম লীগ ৪০ ও কংগ্রেস পায় ৬০টি আসন। অধিকাংশ স্বতন্ত্র সদস্য যোগ দেন মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টিতে। তাই শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগের আসনসংখ্যা হয় ৫৯। আর কৃষক প্রজা পার্টির ৫৫টি।

এ নির্বাচনে কোনো দলই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না। তাই অনিবার্য হয়ে পড়ে কোয়ালিশন। বাংলায় ফজলুল হকের ব্যক্তিত্ব, গ্রহণযোগ্যতা, প্রজা আন্দোলনের শক্তি ইত্যাদি বিবেচনায় গভর্নর তাঁকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলেন। তিনি প্রথমে কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে চান। কিন্তু কংগ্রেস কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে সরকার গঠনে রাজি হয় না। দ্রুত মুসলিম লীগ এ সুযোগ নিয়ে নেয়। তারা ফজলুল হককে মুসলিম লীগের সঙ্গে সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়। ফজলুল হকও আর দেরি না করে ছয়জন মুসলমান ও পাঁচজন হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য নিয়ে সরকার গঠন করেন। এখান থেকে বাংলায় মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্থানের শুরু। তারপর ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত টানা এক দশক মুসলমানরা বাংলার রাজত্ব করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

আর এই দশকের অধিকাংশ সময় বঙ্গবন্ধু কলকাতায় ছিলেন। ১৯৪১ সালে মেট্রিক পাস করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান। এ কলেজের তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় মুখ। কলেজের নির্বাচনে জয়ী হন। তাঁর বিপরীতে কেউ নির্বাচন করে না। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েন অসহায় মানুষের কল্যাণে। ১৯৪৬ সালের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য রাত-দিন কাজ করেন। দেশভাগের ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা যে গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার, তিনি সেটাও দেখলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অর্থের লোভে অন্য দলে যোগ দেয়, জীবনে প্রথম সেটাও দেখলেন। এ দশক বঙ্গবন্ধুর জীবনের এক বাঁক পরিবর্তনের দশক। এ সময় তিনি বিখ্যাত সব রাজনীতিবিদকে দেখেন। তাঁদের সঙ্গে কাজ করেন। রাজনীতির কলাকৌশলও বোঝেন।

মুসলিম লীগে রক্ষণশীল-প্রগতিশীলের দ্বন্দ্ব এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ
১৯৪৩ সালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলর নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর মনোনীত প্রার্থী ছিলেন আবুল হাশিম। আর খুলনার আবুল কাশেম ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিনের প্রার্থী। আবুল কাশেমকে পরাজিত করে আবুল হাশিম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু তখন মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হন। এখান থেকে মুসলিম লীগে দুটি দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে প্রগতিশীল দল। আর নাজিমউদ্দিনের প্রতিক্রিয়াশীল দল। নাজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে এত দিন মুসলিম লীগ সাধারণ মানুষের দল হতে পারেনি। এটা ছিল নবাব, জোতদার, জমিদার ও খান বাহাদুর লীগ। জেলায় জেলায় খান বাহাদুরের লোকেরা একে দখল করেছিল।

এমনিতে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ লেগে থাকে; তার ওপর চল্লিশের দশক থেকে মুসলিম লীগের মধ্যেও বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এক দিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রগতিবাদী দল, আরেক দিকে খাজা নাজিমউদ্দিনের প্রতিক্রিয়াশীল দল। সোহরাওয়ার্দী চাইতেন মুসলিম লীগ সব শ্রেণিও মানুষের দল হোক। খাজা সাহেবরা লীগকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতেন। ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে খাজা নাজিমউদ্দিন মুসলিম লীগকে ব্যবহার করেন। তিনি শুধু খাজা বংশ থেকেই ১১ জনকে আইন পরিষদের সদস্য করেছিলেন; যদিও তিনি তাঁর নিজের এলাকা বরিশাল থেকে নির্বাচিত হতে পারেননি। চরম বিপর্যয় হয়েছিল ফজলুল হকের কাছে।

এদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে গণমানুষের দল করার চেষ্টা করছেন। সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধুসহ প্রগতিশীল দলের সবাই মুসলিম লীগকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যান। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, জনকল্যাণ করতে হলে অবশ্যই দলকে জনগণের দল হতে হবে। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমউদ্দিন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেন। সবার বাধা সত্ত্বেও তাঁর ছোট ভাই খাজা শাহবুদ্দিনকে শিল্পমন্ত্রী করেন। সোহরাওয়ার্দী হলেন সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ছবি: পাভেল রহমান

অবিভক্ত ভারতে মুসলিম লীগের নাম ছিল ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। এই দলের নেতৃত্বে মুসলমানদের জন্য সৃষ্টি হয় পাকিস্তান নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। নিখিল ভারত মুসলিম লীগে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন সভাপতি। লিয়াকত আলী খান সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলেন গভর্নর জেনারেল। আর লিয়াকত আলী খান প্রধানমন্ত্রী।

১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশ ভাগ হয়। ডিসেম্বরে ভেঙে দেওয়া হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। এর ফলে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অবসান হলো। এর উত্তরসূরি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মুসলিম লীগ।

এদিকে দেশভাগের পর খাজা নাজিমউদ্দিন হন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তিনি শুরু থকেই ছিলেন রক্ষণশীল। সাধারণ মানুষ দলের কাছে আসতে পারত না। দলকে সব সময় নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতেন। এ জন্য প্রগতিশীলেরা তাঁর কাছ থেকে সরে যান। তিনি তাঁদের সমর্থন হারান।

কয়েক বছরের মধ্যে মুসলিম লীগে আরও বিপর্যয় দেখা দেয়। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু হয়। ১৯৫১ সালের অক্টোবরে হত্যার শিকার হন লিয়াকত আলী খান। লিয়াকত আলীর মৃত্যুর পর মুসলিম লীগের দায়িত্বে আসেন খাজা নাজিমউদ্দিন।

একটি স্বাধীন পাকিস্তানে জন্য বাঙালি মুসলমানরা দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, দাঙ্গা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ জীবন দিয়েছেন। রক্তের স্রোতে ভেসে গেছে রাজপথ। সবার আশা ছিল স্বাধীন দেশে থাকবে মুক্ত জীবনের অবগাহন। সাবই নিজের কথা বলতে পারবেন। এ জন্যই এত বিসর্জন। এত ত্যাগ। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পরপরই পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বহুদলীয় রাজনীতির পথ বন্ধ করে দেয়। বাঙালিদের ওপর শুরু করে অমানবিক শোষণ-নির্যাতন।

এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এ বাংলায় গড়ে ওঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নিজাম-ই-ইসলামি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, গণতন্ত্রী দল, পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, গণ–আজাদী লীগ ইত্যাদি। সংগঠনের মধ্যে ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ, ছাত্র ফেডারেশন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র অ্যাসোসিয়েশন, ছাত্রসংগঠন ও পর্ব পাকিস্তান যুবলীগ। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পাকিস্তানের দুই অংশে সংগঠন ছিল। কোনো কোনোটির শুধু পূর্ব পাকিস্তানে। এগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের পার্থক্য ছিল। কিন্তু একটা জায়গায় প্রায় সবার মিল ছিল। সেটা হলো সব দল ও সংগঠনের লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তি। এ মুক্তির জন্য ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান, শামসুল হক, বঙ্গবন্ধুসহ প্রগতিশীল নেতৃত্ব একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে। এই দলের নাম হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। চলবে...

আরও পড়ুন