প্রজন্মের ভাবনায় একুশ ও বাংলা ভাষা

ফাইল ছবি

একুশ আমাদের গর্ব, একুশ আমাদের অহংকার। প্রতিবছর একুশ আসে বাঙালির চেতনা ও শিল্পসত্তাকে নতুন করে আরেকবার শাণিয়ে দিতে। একুশের এই চেতনাকে হৃদয়ে লালন, বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে, মোটকথা জীবনযাপনে এর প্রভাব অতুলনীয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনের এক অমর অধ্যায়। এ মাস আমাদের বেদনার কণকপদ্ম, চেতনার অগ্নিমশাল। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই আমরা পেয়েছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। জাতীয় জীবনকে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য অমর একুশের সীমাহীন অবদানের কথা তাই ভোলার নয়। একুশ আমাদের দেশ ও জাতির নতুন ইতিহাসের জন্মদাতা। আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য, আত্মসচেতন হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে মহান একুশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ যে দুর্বার সাহসের পরিচয় দিয়েছিল এবং অগণিত জীবন উৎসর্গ করেছিল, তার প্রেরণা এসেছিল একুশের চেতনা থেকেই।

বাঙালি জাতিসত্তার অনুপ্রেরণা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—সবকিছুই একুশের অনুপ্রেরণায় পাওয়া। আমাদের এই শক্তিকে ভুলে গেলে চলবে না। একুশের চেতনা আমাদের চলার পথের পাথেয়। প্রতিটি প্রজন্মকেই এই চেতনা বুকের মধ্যে লালন করতে হবে।

আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিত্রকলা, ফ্যাশন—আমাদের প্রতিটি শৈল্পিক ভাবনায় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়। একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রাণাবেগকে করে তোলে বেদনাপ্লুত। ভাষার প্রতি বাঙালির শিকড়ের যে টান, তা প্রকাশ পায় বাঙালির লেখায়, রেখায় ও দৈনন্দিন জীবনযাপনে। একুশের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ নানা অঙ্গন। প্রতিবছর বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের গ্রন্থমেলা আজ বাঙালির প্রাণের মেলারূপে বাঙালির হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও। নজরুলসংগীতশিল্পী ও মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠসৈনিক শাহীন সামাদ বলেন, ‘একুশ যতটুকু আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে, আমার মনে হয়, ততটুকু আমরা আমাদের কর্ম, কথায়, চলনে ফুটিয়ে তুলছি না। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ি একুশ নিয়ে অনুষ্ঠান করতে, একুশের গান বাজাতে, পোশাক পরতে। অথচ বাকি সময় আমরা একুশের প্রতি থাকি অনেকটাই উদাসীন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে অতি যত্নে ফুল দিলেও সারা বছর তা পড়ে থাকে অবহেলায়, অযত্নে, এটা দুঃখজনক।

সারা বছরই আমাদের একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ থাকতে হবে। একুশ হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। আমাদের কাজকর্মে, সম্মান-শ্রদ্ধায় তা প্রকাশ করতে হবে।’

একুশের ইতিহাস এ প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের কাছে কতটুকু স্বচ্ছ জানতে চাইলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বলবে, ‘সালাম-বরকতদের প্রাণের বিনিময়ে একুশ পেয়েছি। একুশ এলে শহীদ মিনারে ফুল দিতে হয়—আমরা অধিকাংশ এতটুকুই জানি। কিন্তু প্রাণ দেওয়ার পেছনে কী ইতিহাস, তা আমরা সেভাবে জানি না। আর যদি আমরা আসল ইতিহাসই না জানি, তবে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে কী করে। বাবা-মায়েরা, শিক্ষকেরা আমাদের কাছে এ সম্পর্কে বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরেন না। বইও অনেক সময় আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়। কারণ, একেক বইয়ে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসগুলো আমরা একেকভাবে পাই।’

এত রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চা সম্পর্কে এখনো তরুণ প্রজন্ম সচেতন না। ইংরেজি ভাষায় কথা বলার চর্চা বাড়ছে। অনেকে ইংরেজি বলাকে স্মার্ট মনে করে। শুধু মূল্যবোধের অভাবে বাংলা ভাষা তার নিজস্বতা হারাচ্ছে। একটি দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের তার নিজস্ব ইতিহাস জানা প্রয়োজন। নিজের দেশের ভাষাকে সম্মান করতে না পারলে সে অন্য দেশের ভাষাকে সম্মান করতে পারবে না। শ্রদ্ধা করতে পারবে না। ইতিহাস থেকেই মানুষ শিক্ষা নেয়।

তরুণ প্রজন্ম যদি আধুনিকতার নামে শিকড়কে অগ্রাহ্য করে, তাহলে নিজস্ব ভাষা–সংস্কৃতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। সাবলীল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সদিচ্ছা আর সচেতনতাই পারে বাঙালির এই গৌরবের ভাষাকে প্রজন্মে পর প্রজন্ম টিকিয়ে রাখতে।

তাই একুশের সঠিক ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতে হবে। আজকের প্রজন্মকে আরও বেশি বেশি একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে উৎসাহী করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের রয়েছে ভাষা আন্দোলনের মতো অধ্যায়। আমাদের ভাষায় রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো লেখক, যা পৃথিবীর আর কোনো জাতির নেই। তাই একুশের চেতনায়, ভাষা আন্দোলনের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে।

এখন বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করছে বিশ্ববাসীও, যা একুশের ইতিহাসকে যেমন গৌরবময় করে তুলেছে, তেমন পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষাকে তার নিজস্ব মহিমায় অধিষ্ঠিত করেছে। একুশ বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের প্রথম ভিত। কাজেই একুশের চেতনাকে আমাদের জাতীয় জীবনে ধরে রাখতে হবে। জাতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য আত্মোৎসর্গের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। হিংসা–বিদ্বেষ ভুলে একুশের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।

লেখক: আয়েশা সিদ্দিকা, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।