নিরাপদ সড়ক কবে পাব
সম্প্রতি আবার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও সম্ভাবনাময় ও স্বপ্নের অনেক জীবন অনাকাঙ্ক্ষিত সড়ক দুর্ঘটনার বলি হচ্ছে।
২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলনের পরেও এখন পর্যন্ত শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে, যা খুবই দুঃখজনক।
বর্তমানে করোনাকালেও সড়ক দুর্ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৪৮২ জনের এবং আহত হয়েছেন প্রায় ৪ হাজার জন। সম্প্রতি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে শুধু অক্টোবর মাসেই ৩১৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৩৮৩ জন এবং আহত হয়েছেন ৬৯৪ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৮ জন নারী ও ৪১ জন শিশু। তারা আরও বলছে, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি উভয়ই বেড়েছে। যেখানে সেপ্টেম্বের সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২৭৩টি এবং নিহত হয়েছিলেন ৩০৪ জন।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, অদক্ষ-মাদকাসক্ত চালকের গাড়ি চালানো, রাস্তাঘাট নির্মাণে ত্রুটি, পদচারী–সেতু ব্যবহার না করা, ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা পারাপার এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রী দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখা, পাঁচ ঘণ্টা পরপর চালক পরিবর্তন করা, চালক ও সহযোগীদের প্রশিক্ষণ, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট রাখা বাধ্যতামূলক এবং মহাসড়কের পাশে চালকের জন্য বিশ্রামাগার—এই পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা–ও পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। যা কিছুটা হলে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দুর্ঘটনার এই সব কারণ জানা সত্ত্বেও কেন শৃঙ্খলা ফিরছে না সড়কে? কবে নাগাদ নিরাপদ হবে আমাদের সড়কপথ?
নিরাপদ সড়ক চাই-এর তথ্যমতে, দেশে সড়কে প্রতিদিন গড়ে ১৮ জন মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় এভাবে প্রাণহানির ফলে মানবিক ও অর্থনৈতিক যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা নির্ণয় করা দুরূহ। এক হিসাবে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় যাঁরা মৃত্যুবরণ করেন, তাঁদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এই পরিবারগুলো রীতিমতো পথে বসে যায়। আহতদেরও অনেকে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ফলে তাঁদের পরিবারও বিপন্ন হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতির পরিমাণ ধরা হলে তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ। সবচেয়ে বড় কথা, জীবনের চেয়ে দামি কিছু হতে পারে না। আর সেই জীবনই অকালে থেমে যাচ্ছে এই সড়ক দুর্ঘটনায়।
সময় এসেছে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সড়ক ও পরিবহন খাতের স্থবিরতা কাটিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের। ইতিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর লক্ষ্যে আদালত চারটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। যথা গাড়ি চালানোর পূর্বে চালক, চালকের সহযোগী ও সুপারভাইজারদের ডোপ টেস্ট; যাত্রীদের সঙ্গে কর্কশ ও অভদ্র আচরণ না করতে চালক, সুপারভাইজার ও চালকের সহযোগীদের আচরণসংক্রান্ত কাউন্সেলিং বিষয়ে উচ্চতর পদক্ষেপ গ্রহণ; মহাসড়কে প্রতি তিন কিলোমিটার পরপর বাথরুমের ব্যবস্থা এবং ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে যান চলাচলের ওপর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা। আমরা চাই এই উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক।
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো কঠিন নয়, শুধু দরকার আমাদের প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের। প্রথমত, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রথম বিআরটিএ থেকে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করার বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত, চালকদের বেপরোয়া প্রতিযোগিতার মনোভাব ও গতি রুখতে সচেতনতা এবং প্রক্ষিণের ওপর জোর দিতে হবে। তৃতীয়ত, লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির যান চলাচল নিষিদ্ধসহ নতুন করে লাইসেন্স ব্যতীত ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল করতে যেন না পারে, সে জন্য কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপের বিকল্প নেই। তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত যানবাহন ৪৪ লাখ আর চালকের নিবন্ধন সংখ্যা ৩২ লাখ। ১২ লাখ চালক কম, যা স্বভাবতই ভুয়া চালক; আর এঁদের দ্বারাই দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। তাই এখানে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই।
চতুর্থত, নির্মাণ–ত্রুটির কারণে সড়কে যে ব্যাক স্পট/দুর্ঘটনাপ্রবণ মোড় রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সংস্কার জরুরি। পঞ্চমত, ট্রাফিক আইনকে কার্যকর করা, ঘুষমুক্ত রাখা ও চালকদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান জরুরি। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোতে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে এমনভাবে প্রচারণা করতে হবে, তা যেন সবারই দৃষ্টিগোচর হয়।
ষষ্ঠত, সড়কে পুলিশ ও মোবাইল কোর্টকে আরও বেশি সক্রিয় করে তুলতে হবে। সপ্তমত, সড়কে চাপ কমাতে নদী ও রেলপথকে সক্রিয় করা যেতে পারে। অষ্টমত, সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় সমাজের বিত্তবান বা প্রভাবশালী কেউ নিহত হলে সে ক্ষেত্রে চালককে গ্রেপ্তার সম্ভব হয়। অন্যদিকে বেশির ভাগ সময় সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে চালক গ্রেপ্তার কিংবা আর্থিক ক্ষতিপূরণ কোনোটাই পায় না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে আইনের স্বচ্ছতা আনয়ন জরুরি। সর্বশেষ, পথচারী ও যাত্রীদের অধিক সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টায় পথচারীদের ফুটপাত, আন্ডারপাস ও পদচারী–সেতু ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের নিজ নিজ জায়গা থেকেও সচেতন হতে হবে।
অনাকাঙ্ক্ষিত সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিভিন্ন সময় নেওয়া উদ্যোগ বাস্তবায়নে এবং সড়ক আইনের ধারাবাহিকতা অনুশীলনের ওপর জোর দেওয়ার বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বিত পদক্ষেপ, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জনগণের সচেতনতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে—এমনটাই প্রত্যাশা।
*শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]