দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু হল
তুমুল বৃষ্টি, আগস্টের শুরু, ১৯৯৭ সাল, আধহাঁটু জল ভেঙে হলে উঠলাম। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, বাড়ি থেকে খবর পেয়ে ছুটে এলাম রাজধানী শহরে। ওঠার জায়গা বলতে মামার বাসা—পল্টন। বুদ্ধদেব বসুর সেই পুরানা পল্টন, আমরাও তিনজন—মামা, মেজ ভাই আর আমি। হলে উঠব আগে থেকেই ঠিক করা। কিন্তু কীভাবে তা জানা ছিল না। যোগাযোগের একজন সুহাস ভাই থাকেন হলে। তা–ও বঙ্গবন্ধু হলে। আমার সিটও পড়ল বঙ্গবন্ধুতে।
কলা অনুষদের দোতলায় ক্লাস করছি। এক ক্লাসের ফাঁকে আরেক ক্লাস, ১০ মিনিটের বিরতি। হঠাৎ দেখি সুহাস ভাই, আমায় খোঁজে। বলে, ‘কী মিয়া, কোথায় তুমি খুঁজবে, না আমি তোমারে খুঁজে হয়রান। হলে ওঠার ঝামেলা তো জানো না। বুঝতে কেউ না থাকলে!’ এক্কেরে খাঁটি কথা, সেটা বুঝলাম। জীবনে এই প্রথম হল বা মেসে উঠলাম। সে এক অদ্ভুত জায়গা, অন্তত আমার কাছে তখন। চার খাট; লোক আট, আরও বেশি কোথাও! সুহাস ভাই থাকেন ১১৯–এ। সেখানে, তার জায়গায় আমার আবাস, নাহ একক কোনো খাট নয়, প্রশ্নই আসে না। ডাব্লিংয়ে সিনিয়র এক ভাইয়ের সঙ্গে। সুহাস ভাই চলে যাচ্ছেন জহুরুল হক হলে, তাঁর গন্তব্যে! ক্লাস শেষে ১১৯–এ গেলাম; আমার ভবিতব্য ভবিষ্যৎতে। নিচতলায় সিঁড়ির পাশের প্রথম রুম, টোকা মেরে ঢুকে পড়লাম, ‘থাকবার আইছি! সুহাস ভাই পাঠিয়েছেন’, ওটুকুই! বলতেই মুনিবুর বলল, ‘এসো, আমরা একই গোয়ালের গরু।’ তৃতীয় বর্ষের সূর্যদা বললেন, ‘আরে সব ইংরেজে ভরে গেল। দেখ দেখি কী কাণ্ডকারখানা।’ ছুটলাম তিন রুম পেরিয়ে ১২৩–এ। মুনিবুরই নিয়ে গেল এক বড় ভাইয়ের কাছে, মোশাররফ ভাই শুয়েছিলেন; সালাম দিয়ে উপস্থিতির কথা জানালাম, সুহাস ভাইয়ের রেফারেন্স; শুরু হলো হল জীবন।
হলে ৫–৬ বছরের যাপিত জীবন। এ রুম সে রুম—১১৯, ১১৮ পেরিয়ে থিতু হলাম ৪০৫–এ। অম্লমধুর অভিজ্ঞতা। কিন্তু সুন্দরতম সময়ের সাক্ষী, জীবন–সঞ্জীবনী! অনেক টানাপোড়েন; তবু কেন জানি বিশ্ববিদ্যালয় এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়। হল মানে সমগ্র বাংলাদেশ ১০০ টন! দেশের প্রায় সব জেলার ছেলেদের আবাস; তাদের কৃষ্টি-কালচার, ওঠাবসা, কথা বলা! একটা সামগ্রিক অভিজ্ঞতার আধার, আর থাকে শেয়ারিং, একে অন্যের প্রতি দারুণ সহযোগিতা! অসুখবিসুখ, সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ান।
বাইরে থেকে ফিরছি—দেখা গেল, বারান্দায় টাঙানো লুঙ্গি কী পরিপাটি ভাঁজ করে বন্ধু মুনিবুর রেখে দিয়েছে। জ্বর হয়েছে, কেউ একজন মাথায় হাত রাখল, শান্তির পরশ! খাওয়ার সময়—সকাল-দুপুর-রাত্রি রুমমেটরা দল বেঁধে চলে গেলাম মেসে, খাওয়া শেষে ঢেকুর তুলতে তুলতে ওপরে দোতলায় টিভি রুমে কিছুক্ষণ গানবাজনা দেখা।
নয়তো খবরের কাগজ-ম্যাগাজিনে চোখ বোলানো। কেউ কেউ নিয়ম করে শেষ সময়ে খেতে আসে; বিশেষত রাতে, ঘড়ির কাঁটা ধরে রাত ১০টায়; এ গ্রুপে ছিলেন মনোবিজ্ঞানের কামাল-মিলন ভাই। আমরাও জুটে যেতাম একই টেবিলে। তখন সিনিয়র-জুনিয়র একাকার হয়ে চলত জম্পেশ আড্ডা। এসব ভাইয়ের একদিন দিন ফুরাত। ঘনিয়ে আসত হল ছাড়ার দিন। জীবনের প্রাইম টাইমের একটি খসে পড়ত গভীর মনোবেদনা আর অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতে পা ফেলার মধ্য দিয়ে। আবার প্রাক্তনেরা ফিরে আসে জাবর কাটা স্মৃতি জাগ্রত করতে, স্ত্রী-সন্তানসহ। সেলিম মামার ফ্লাক্সভর্তি পরিবেশিত চায়ে চুমুক দিয়ে ফিরে যেতে ১৫–২০ বছর আগের সেই জীবনে!
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষ্ঠুর-মধুর বাস্তবতা হলো—সে কখনো বয়স্কদের ধারণ করে না; তরুণ-তাজারাই কেবল বরিত! ছেড়ে দেয় বৃদ্ধদের! ইয়েটসের সেই কবিতা ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ডমেন’; পঁচিশোর্ধ্ব বৃদ্ধদের জায়গা কোথায়!
*লেখক: জিল্লুর রহমান, প্রাক্তন ছাত্র, ইংরেজি বিভাগ। বর্ষ ১৯৯৬-৯৭