ঠাকুরগাঁওয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন প্রাণের দাবি

রিকশাচালক পিতার সাত মাস বয়সী শিশু জান্নাত রক্ত পায়খানা করায় ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেলে পাঠান। কিন্তু কীভাবে রংপুরে আসবেন? চিন্তায় পড়ে যান শিশু জান্নাতের পিতা তারেক। ওই সময় তাঁর পকেটে মাত্র ২০০ টাকা।

অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার কথা ভাবতেও পারছিলেন না। অন্যের কাছে ধারদেনার চেষ্টা করেও কিছু পেলেন না। অবশেষে নিজের রিকশা চালিয়েই সন্তানকে নিয়ে রংপুরে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন পিতা তারেক।

ঠাকুরগাঁও থেকে রংপুরের দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার। চার্জার রিকশা চালিয়ে মেয়েকে নিয়ে রংপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। ব্যাটারি ঠিকমতো চার্জ দিতে পারেননি তিনি। ধীরগতিতে চলা রিকশার চার্জ শেষ হয়ে যায় পথে। অবশেষে অন্যদের সাহায্য নিয়ে দীর্ঘ ৯ ঘণ্টায় মেয়েকে নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান তারেক। ঘটনাটি সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ে ঘটেছে।

ঠাকুরগাঁও থেকে এ রকম কত লোক রোগী হয়ে রংপুর ডাক্তারের কাছে ও হাসপাতালে যাচ্ছেন, তা বোঝা যায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করলে। কারণ, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার এ রকম নানা বৈষম্য আছে গ্রামে ও শহরে, আছে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণিতে। মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি হলো উপযুক্ত চিকিৎসাপ্রাপ্তি। চিকিৎসাসেবা দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে তা সহজলভ্য হয়ে উঠছে না।

আধুনিক চিকিৎসার মূল কেন্দ্র হলো মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। দেশ-বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অধ্যাপকেরা শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের পাঠদানের পাশাপাশি হাসপাতালে ভর্তি করা রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। বিকেলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-সংলগ্ন এলাকায় প্রাইভেট ক্লিনিক বা চেম্বারে স্বল্প মূল্যে রোগীদের চিকিৎসা দেন। এমনকি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ভর্তি করা জটিল রোগীদের প্রয়োজনে ডাকলে রাত–দিন ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। এসব মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে নবীন চিকিৎসকেরা নিকটস্থ শহর-উপশহরে ক্লিনিক, হাসপাতাল গড়ে তুলে চিকিৎসাসেবা তৃণমূলে প্রসার ঘটাচ্ছেন।

দেখা যায়, যেসব জেলায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেসব জেলার জনগণ আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণের সব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। পাশের জেলার অনেক রোগী এসব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে গিয়ে যোগাযোগ, আসা-যাওয়া ও খাবারের জন্য নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন।

বর্তমানে দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৭টি। রংপুর বিভাগে আটটি জেলা। তার মধ্যে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, নীলফামারী মেডিকেল কলেজ।

ঠাকুরগাঁওয়ে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতাল আছে। এখানে মেডিসিন, সার্জারি, অর্থোপেডিক, নিউরো সার্জারি, গাইনি, রেডিওলজি, শিশু, দন্ত, প্যাথলজি ইত্যাদি প্রায় সব বিভাগ আছে। চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের আবাসিক সুযোগ-সুবিধাও বিদ্যমান। শুধু অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ দুটি নতুন পদ সৃষ্টি এবং কনসালট্যান্টদের যোগ্যতা অনুসারে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক পদে পদায়ন করে মেডিকেল কলেজ হিসেবে উন্নীত করা সম্ভব। চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়ানো সম্ভব। যদি তাই হয়, এখানে এমবিবিএস, নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কোর্সে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রী, ইন্টার্নি চিকিৎসকদের পদচারণে মুখরিত হবে ঠাকুরগাঁও। তখন জনসাধারণের সঙ্গে, বিশেষত পল্লির দরিদ্র মানুষের সঙ্গে ভবিষ্যতের চিকিৎসকদের পরিচিতিও বৃদ্ধি পাবে। এর জন্য সরকারের কোষাগার থেকে বাড়তি বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলির ভাষণে বাংলাদেশের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক জেলায় একটি করে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাও দিয়েছিলেন।

ঠাকুরগাঁওয়ে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্য অধিকার সুরক্ষার জন্য সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আর তাহলেই সবাই সম্মিলিতভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য স্লোগান বাস্তবে পরিণত হবে।

দেশের সর্ব উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঠাকুরগাঁও। জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ৫টি উপজেলা, ১টি থানা, ৫৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই জেলার মানুষের শিক্ষার হার ৪৯ দশমিক ৪৩। প্রত্যন্ত এই জনপদে ৯১টি মহাবিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ১টি, কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র ১টি, ২৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৩৯টি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৬৯টি মাদ্রাসা ও ৯৯৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। তবে এই জেলায় শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য নেই কোনো পাবলিক অথবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর জেলার প্রায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের বেশ বেগ পোহাতে হয় উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় এই জনপদের বাইরে ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম অথবা দেশের যেকোনো প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। মেয়েদের বেলায় পরিবারের সঙ্গে তা রীতিমতো যুদ্ধ বলা চলে। অনেক কাকুতিমিনতি করার পর খুব কমসংখ্যক মেয়েরই সুযোগ হয় উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার।
অপার সম্ভাবনাময় এই জনপদে মেডিকেল কলেজ খুবই যুগোপযোগী। দূরত্বের কারণে এই অঞ্চলের মানুষকে সঠিক চিকিৎসাসেবা পেতে চরম দুর্বিষহ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। কারণ, দূরত্ব বেশি হওয়ায় ভালো চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ হয় না মৃত্যু পথযাত্রী রোগীদের। কিন্তু একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থাকলে, সেই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি পেত ঠাকুরগাঁওবাসী।

সর্বোপরি উচ্চশিক্ষা বিস্তারে ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত ঠাকুরগাঁও জেলার ২০ লাখ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন ঠাকুরগাঁওবাসীর প্রাণের দাবি।