ট্রল সংস্কৃতি ও সোশ্যাল মিডিয়া

ছবি: রয়টার্স

তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান আধুনিকতার এ সময়ে দাঁড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন না—এমন মানুষ খুব একটা পাওয়া যায় না। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপসহ আরও কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেকাংশেই দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোর ওপর আজ আমরা অনেকটাই নির্ভরশীল। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের একটি বিরাট অংশ বর্তমানে তাদের জীবনের একটি বড় অংশ এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করে থাকেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তার সুবাদে কমবেশি সবাই আমরা ট্রল শব্দটির সঙ্গে বেশ পরিচিত। ট্রল একটি ইংরেজি শব্দ। সাধারণভাবে ট্রল শব্দটার পেছনে একধরনের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাপার থাকে। কোন প্রতীকী চরিত্র বা পরিচিত মুখকে ব্যবহার করে ঠাট্টা বা মজার ছলে একটা প্রতিবাদ সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুস্থ বিনোদনটির নামই ট্রল। মূলত, ট্রল শব্দটা দিয়ে ছবি বা কার্টুন ব্যবহার করে কোনো একটি বিষয়ে স্যাটায়ার ও সমালোচনা করা বোঝানো হয়ে থাকে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে ট্রল বিষয়টি আদতে খারাপ কোনো বিষয় না।

কিন্তু এর শাব্দিক অর্থ প্রকৃতপক্ষে যেটাই হোক না কেন, ফেসবুকের এ যুগে আমরা ট্রল শব্দটি দ্বারা বিভিন্ন বিষয়ে মজা করা কিংবা ব্যঙ্গ করাকেই বুঝি। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ট্রল করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। জাতি হিসেবে আমরা যে কতটা ট্রলপ্রিয়, তা সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কর্মকাণ্ড দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের খোরাক জোগাতে প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ইস্যু। একটির পর আরেকটি ইস্যু আসতে থাকে আর সেটি নিয়েই দেদার চলতে থাকে ট্রল। ট্রল বিষয়টি আদতে খারাপ না, কিন্তু ট্রলের নামে আমাদের দেশে এমনকি এই উপমহাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা করা হয়, তা অনেক সময় ট্রলের পর্যায়ে থাকে না। অনেক সময় তা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা বস্তু সম্পর্কে অহেতুক ভুল ও নেতিবাচক তথ্য পরিবেশনের একটি মাধ্যমে পরিণত হয়। বেশ কিছু দিন ধরেই ফেসবুকে চলছে বাঙ্গি নিয়ে তুমুল ট্রল ও হাসিঠাট্টা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পুষ্টিকর ফল নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি রকমের ট্রলের কারণে অনেক মানুষের কাছে এটি সম্পর্কে একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে বাজারে বাঙ্গিচাষিরা এর ন্যায্য মূল্য তো পাচ্ছেনই না, উল্টো বাঙ্গি একটি হাসিঠাট্টার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটি বিরাট অংশ বুঝে বা না বুঝেই রীতিমতো এটা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে যে বাঙ্গি নিয়ে হাসিঠাট্টা বা ট্রল করাটা একটা বেশ গর্বের ও স্মার্টনেসের ব্যাপার।

হোয়াটসঅ্যাপ
ছবি: রয়টার্স

এটি তো গেল একটি মামুলি ব্যাপার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের নামে শুধু এসব বিষয় নিয়েই রঙ্গরস হয় না; অনেক ক্ষেত্রে রীতিমতো সাইবার বুলিংয়ের মতো মারাত্মক সাইবার অপরাধও ঘটে যাচ্ছে নিছক ট্রলের আড়ালে। ২০২০ সালের অক্টোবরের হিসাবমতে, বাংলাদেশে ১১ কোটি ৭ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে বড় অংশ নারী। কিন্তু তাঁদের সাবলীলভাবে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে ছবি, ভিডিও, কমেন্ট যেকোনো ট্রল হওয়ার শঙ্কায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই ট্রলের নামে নারীর প্রতি সহিসংতার ঘটনা দেখা যায়। ফেসবুকে যেকোনো নারীর কোনো পোস্টের কমেন্ট সেকশনে গেলে তার দেহ, পোশাক কিংবা পরিবার নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য দেখা যায়। এ ধরনের অযাচিত, অশোভন ও অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্যের কারণে ব্যক্তিগতভাবে ভুক্তভোগী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আজকাল অনেক শিক্ষিত মানুষ বুঝে কিংবা না বুঝে এভাবে অনলাইনে হয়রানি করার মাধ্যমে সাইবার বুলিংয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন।

শুরুর দিকে এটি শুধুই মজা করার জন্য করা হলেও এখন তা অনেকের জন্যই ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো হয়ে গেছে। আজকের দিনে ট্রল বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় যেসব চালানো হচ্ছে এবং যা বেচে অর্থ না হোক অনেকেই তথাকথিত পপুলারিটি কামানোর নামে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে অন্যের দুর্বলতাকে হাতিয়ার বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনসমক্ষে ট্রল করে ব্যক্তিটিকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

বিভিন্ন তরকা ও সেলিব্রিটির ফেসবুকের কমেন্ট সেকশন লক্ষ করলেই বিষয়টির সত্যতা উঠে আসবে। আধুনিকতা শব্দটির মধ্যে বেশ একটা ভারিক্কি ব্যাপার রয়েছে। আমরা এ আধুনিক যুগের বাসিন্দা হওয়ায় প্রতিনিয়ত পারিপার্শ্বিকতায় যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি। সস্তার বিনোদন নেওয়ার জন্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে অবশ্যই আমরা ট্রলের নামে হেট স্পিচ ছড়াতে পারি না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক কিছুই আমাদের ভালো না লাগতেই পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি উপেক্ষা করে যেতে পারি কিংবা তার গঠনমূলক সমালোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগের এই দুনিয়ায় আমরা যে ট্রলের সংস্কৃতি গড়ে তুলছি, তা অদূর ভবিষ্যৎ আমাদের মনুষ্যত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

রয়টার্স

ট্রল হয়তো একেবারে নির্মূল করার কথা বলা যাবে না; কিন্তু আমাদের ট্রল করার ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। সুস্থ ধারার বিনোদনমূলক ট্রল করা যেতে পারে। কিন্তু ট্রলের নামে সাইবার বুলিং, হেট স্পিচ কিংবা নেতিবাচকতা ছড়ানো বন্ধ করতে হবে। যারা ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ায়, তারা কখনো সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে পারে না। তারা তাদের বিকৃত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে। এ ধরনের চক্রকে রুখে দিতে হবে। সেই সঙ্গে পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি টিমকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচকতাকে বাদ দিতে ইতিবাচক ও পজিটিভ চিন্তাভাবনাগুলোকে সবার মাঝে আরও বেশি বেশি ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলতে পারব একটি সুস্থ ও হয়রানিমুক্ত সোশ্যাল মিডিয়া।

*লেখক: মুশফিকুর রহমান ইমন, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।