করোনায় শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাজট: অনলাইন ক্লাসই কি একমাত্র ভরসা

ছবি: সংগৃহীত

করোনা শুধু মানুষের জীবনই কেড়ে নেয়নি, শিক্ষাব্যবস্থাকে পাঠিয়ে দিয়েছে আইসিইউতে। স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে নামমাত্র অনলাইন ক্লাসেই চলছে করোনাকালীন শিক্ষাব্যবস্থার পরিচর্যা। পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত অবকাঠামো তৈরি না হওয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অনলাইন কার্যক্রম। আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কমবেশি চিত্র এটি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের এক নির্বাচনী ভাষণে বলেছিলেন, ‘সুসমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।’

এবার দেখা যাক বিগত ২ অর্থবছরের শিক্ষা খাতের বরাদ্দ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিক্ষা ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৬১ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬৬ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। সরকার জাতীয় বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়ার বৈশ্বিক অঙ্গীকার করলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকার শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়েছে ১১.৬৯ শতাংশ। প্রতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে এই বরাদ্দ পর্যাপ্ত কি না, তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।

শিক্ষা খাতে বরাদ্দের বেশির ভাগ অর্থ ব্যয় করা হয় শিক্ষক, কর্মকর্তা–কর্মচারীর বেতন ভাতা পরিশোধে। শুধু তা–ই নয়, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাজেটের তিন ভাগের দুই ভাগ ব্যয় করা হয় বেতন–ভাতা পরিশোধে। শিক্ষার্থীদের ভাগ্যে জোটে অনলাইন ক্লাস আর অটোপাস।

শিক্ষাবর্ষ রক্ষা করতে এসএসসি ও এইচএসসি পর্যাযে দেওয়া হয় অটোপাস, যা নিয়ে সমাজের বিভিন্ন মহলে সৃষ্টি হয়েছে সমালোচনা। প্রশ্ন উঠেছে অটোপাসের কার্যকারিতা নিয়েও। বহির্বিশ্বে একটি দেশের উন্নয়নে শিক্ষা খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হলেও স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ‘অটোপাসের’ এ উন্নয়নে শিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু অগ্রসর হয়েছে, সে প্রশ্ন রয়েই যায়।

ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গবেষণা। কিন্তু সবচেয়ে হতাশার জায়গা গবেষণা খাত। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ১২৫টি সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোট মাত্র ১৫৩ কোটি টাকা গবেষণায় ব্যয় করেছে। অর্থাৎ প্রতিটির গড় বার্ষিক খরচ ছিল ১ কোটি ২২ লাখ টাকা। তাদের সব ধরনের খরচের তুলনায় মাত্র ১ শতাংশ। দেশের ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না কোনো বরাদ্দ।

গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২তম। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জীর্ণদশা আমাদের সামনে নতুন করে উঠে এসেছে। দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। করোনার সংকটকালে সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে এগিয়ে চলছে তাদের পাঠদান কার্যক্রম। গড়ে তোলা হয়েছে অনলাইনভিত্তিক গ্রহণযোগ্য শিক্ষাব্যবস্থা। সময়মতো শেষ হচ্ছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা। শুধু তা–ই নয়, ৮ এপ্রিল দেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি তাদের ২৩তম সমাবর্তন আয়োজন করেছে অনলাইনে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বয়সের ভারে নতজানু হলেও নেই কোনো প্রযুক্তির ছোঁয়া, উপজেলায় উপজেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হলেও নজর দেওয়া হচ্ছে না গঠনমূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন এবং প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়নে। জৌলুশ হারাচ্ছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কাঠামো। ফলে অনেক অভিভাবক তাঁদের পছন্দতালিকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে রাখছে।

বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল, ইউরোপের অনেক দেশকে অর্থনীতিতে পিছনে ফেলেছে; তবুও কেন আজ দেশের হাজারো শিক্ষার্থীর মুখে হতাশার ছাপ? একই সময়ে শুরু করা শিক্ষাবর্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শেষ করতে পারলেও কেন পারছে না দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো?

করোনা সর্বস্তরের মানুষের জন্য চিন্তার বিষয় হলেও শিক্ষার্থীদের জন্য অসহনীয় এক যন্ত্রণার নাম। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শতভাগ সেশনজটমুক্ত করা যায়নি এখনো। তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হলো শিক্ষাবর্ষ বিপর্যয়। হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে শিক্ষার্থীসমাজ। এই বিপর্যয় থেকে উত্তরণের উপায় কী?

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক আবুল হায়াত বলেন, ‘করোনাকালীন এই সংকট আমাদের পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তবে এর ক্ষতি আমরা কমাতে পারি। অনলাইন ক্লাস সরাসরি ক্লাসরুমে পড়ানোর মতো না হলেও আমাদের ইতিবাচক হিসেবে দেখা উচিত। ১১ মাসের বেশি সময় ধরে অনলাইন ক্লাস চলছে, যা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। পরবর্তী সময়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হবে, তখন ১৫-২০ দিনের ব্যবধানে আমরা সেমিস্টার পরীক্ষাগুলো শুরু করে দেব। ফলে নতুন করে ক্লাস নিতে গেলে যে সময় লাগত, সেটার আর প্রয়োজন হবে না। এতে সেশনজট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। শিক্ষার্থীদের হতাশ না হয়ে নিজের স্কিল ডেভেলপ করে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিজেকে এগিয়ে রাখা উচিত এ সময়ে। করোনার অনেক নেতিবাচক দিকের মধ্যে ইতিবাচক দিক হলো এটি আমাদের নতুন করে চিন্তা করার এবং আমাদের স্বপ্নগুলোকে নতুন আঙ্গিকে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে।’

বৈশাখের এই তপ্ত রোদে নিপাত যাক করোনাভাইরাস। চক-ডাস্টারের টুকটাক শব্দে প্রাণ ফিরে আসুক প্রিয় ক্লাসরুমে।

*লেখক: তাসফিক আবদুল্লাহ চৌধুরী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়