ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের বাস্তবতা ও বর্তমান অবস্থা

১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

পূর্ব বাংলা একদিন স্বাধীন হবেই। ১২ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।’ কাগমারী সম্মেলনের একফাঁকে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে মাওলানা ভাসানী এ কথা বলেছিলেন। ১৪ বছর পর ঘটলও তা–ই। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হলো।

ঠিক কবে থেকে বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। তবে পলাশীর প্রান্তরে অস্তমিত হয়ে যাওয়া স্বাধীনতার বাসনা ছিল মানুষের অন্তরে। সেই বাসনা তেজোদ্দীপ্ত করতে প্রথমে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্তরের রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে এ দেশের ফকির, সন্ন্যাসী, সেপাই, জনতা, আলেম, ওলামা, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই–সংগ্রাম করেছেন। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস, মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছে। কিন্তু পৃথকভাবে বাংলার স্বাধীনতার কথা কজনই–বা ভেবেছেন। যাঁরা ভেবেছেন, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

আসামে বাঙ্গাল ‘খেদাবিরোধী’ আন্দোলন, লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন—এসব করতে গিয়েই মাওলানা ভাসানী প্রথম বাঙালি জাতিসত্তার অনুকূলে পৃথক একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নবীজ বপন করেছিলেন। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ‘স্টেটস’ শব্দটি তাঁকে আশাবাদীও করে তোলে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মেটাতেই তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের তরিতে উঠেছেন। তবে এসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে থেকেও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির। ভাসানীকে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে অন্য কোনো নেতার তুলনা আনতে হয় না। তাঁর সময়ে কিংবা তাঁর আগেপরে যত নেতা এসেছেন, মাওলানা ভাসানী সবার থেকে আলাদা এক চরিত্র। কিংবা বলা যেতে পারে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আদর্শিক জগৎ, যেখানে মিলবে না মহাত্মা গান্ধী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, সুভাসচন্দ্র বসু অথবা জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো কোনো চরিত্র।’ আর তাই তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জুড়ে দিয়েছিলেন জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলন, কৃষক–প্রজার মুক্তির আন্দোলন ইত্যাদি।

কংগ্রেস, মুসলিম লীগের জমিদার শ্রেণির অনেক নেতাকেই ভাসানী তাঁর আন্দোলনে শামিল করে ছেড়েছেন। অন্যদিকে কৃষক–মেহনতি শ্রেণিকেও তাঁদের মুক্তিসংগ্রামে সোচ্চার করে তুলেছেন। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির শেষ সময়েও তিনি সিলেটের সফল গণভোট আর আসামে গণভোটের প্রস্তাব পেশের মধ্য দিয়ে বড় বাংলার ক্যানভাস আঁকতে চেয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ তাঁর সেই আশা পরিপূর্ণভাবে মেটাতে পারেনি। মাওলানা ভাসানী মাওলানা ভাসানীই। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হতে না হতেই তিনি বাঙালি চেতনার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি চেতনার দ্বৈরথ আর শোষণের নয়া মেরুকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হলেন।

কাগমারী সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছেন মওলানা ভাসানী, পাশে বসা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
ছবি: সংগৃহীত

১৯৪৮ সালের শুরুতেই মাওলানা ভাসানী উচ্চারণ করতে বাধ্য হলেন, ‘আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম?’ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করলেন। ১৯৫৪ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশ্চিত করলেন। কিন্তু ক্ষমতা লাভের পর আওয়ামী লীগকে পুরোনো পথে হাঁটতে দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। আয়োজন শুরু করলেন কাগমারী সম্মেলনের। ১৯৫৭ সালের ৬-১০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের অজপাড়াগাঁ সন্তোষ-কাগমারীতেই তিনি ডাক দেন আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগপ্রধান হিসেবে নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তি উদ্যোগে আয়োজিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন বাংলাদেশের প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক কাম রাজনৈতিক সম্মেলন হিসেবে অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর তার সাংস্কৃতিক চৈতন্যোদয়ের ডাক দেন।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে, ‘এমন একটি সাংস্কৃতিক আয়োজন অবিভক্ত বাংলায় আগে ও পরে অথবা কখনো হয়নি।’ কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মাওলানা ভাসানী বস্তুত স্বাধীন জাতিরূপে বাঙালি আর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক ভিতভূমি নির্মাণ করেন। এই সম্মেলনে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানিয়ে শুধু স্বাধীনতার আগাম ঘোষণাই দেননি, একটি স্বাধীন দেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দর্শনও উন্মোচন করে দেন। সম্মেলনটি নামে সাংস্কৃতিক সম্মেলন হলেও সেখানে ভাষা, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি, ভূমিব্যবস্থা, কৃষি, রাসায়নিক শিক্ষা, নারীসহ বিশদ বিষয় ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের ভাষা’, ড. কুদরত-ই-খুদা ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাসায়নিক শিল্পের ভবিষ্যৎ উন্নতি’, ড. মাহমুদ হোসেন ‘অন দ্য কনসেপ্ট অব ইসলামিক কালচার’, ড.গোবিন্দ চন্দ্র দেব ‘পূর্ব পাকিস্তানে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব’, ড. আখলাকুর রহমান ‘থটস অন দ্য ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাসপেক্ট অব দ্য ডেভেলপমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার’, শওকত ওসমান ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্য’, ড. মুহাম্মদ ওসমান গনি ‘বিকল্প খাদ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা ও পন্থা’, আবদুল হাকিম ‘পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা’, অধ্যক্ষ ওসমান গনি ‘পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম’, ড. নুরুল ইসলাম ‘পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন’, বি এম আব্বাস ‘সেচব্যবস্থা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ’, ড. সামসুদ্দিন আহমদ ‘অন হার্ট ডিজিস’, ডা. এম এন নন্দী ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়নে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা’, কুলসুম হুদা ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ’ বিষয়ে সম্মেলনে আলোচনা করেন।

তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রায় সব বয়সের প্রগতিবাদী লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার, সংগীতাজ্ঞ, সাংবাদিকসহ ভারত, ব্রিটেন, মিসর, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভৃতি দেশের প্রতিনিধিরা কাগমারী সম্মেলনে অংশ নেন। সম্মেলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এ দেশের মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি, মজলুম মানুষের জন্য সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি প্রতিচ্ছবি ভাসানী আঁকতে চেয়েছিলেন এই কাগমারীতে বসেই। আর কি হবে সেই স্বাধীন দেশের মানচিত্র, চিন্তা আর বোধের ধারণা?

কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রবল প্রকাশ ঘটিয়েছেন। রাজনীতি আর সংস্কৃতির স্রোতোধারাকে এক মোহনায় টেনে আনেন। যে পথ ধরে হেঁটে হেঁটেই আমরা স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা ও স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় কাগমারী সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত সেই আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় আমরা ধারণ ও বহন করতে পারিনি। তাই ঘুণে খাচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার ফসল। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও আমরা যেন উদ্ভট উটের পিঠে নিরুদ্দেশ যাত্রা করে চলেছি। এই নিরুদ্দেশ যাত্রা ঠেকাতে কাগমারী সম্মেলনের চেতনা আমাদের কাঙ্ক্ষিত দেশ গড়ার পথ দেখাতে পারে। কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। এই মাইলফলক এড়িয়ে অন্য কোনো পথে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস সঠিক পূর্ণতা পায় না।

তথ্য সূত্র: ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’, সৈয়দ আবুল মকসুদ, কাগমারী সম্মেলন স্মারকগ্রন্থ ; ‘ভাসানী কাহিনী’, সৈয়দ আবুল মকসুদ; ‘কাগমারী সম্মেলন’, সৈয়দ আবুল মকসুদ; ‘ভাসানীর কাগমারী সম্মেলন ও স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম’, শাহ আহমদ রেজা, মজলুম জননেতা হলমার্ক সংকলন।

লেখক: মওলানা ভাসানীর নাতি, সভাপতি, মওলানা ভাসানী কৃষক সমিতি