একজন সাকিব এবং বাংলাদেশ

সাকিব আল হাসান
ফাইল ছবি

জীবন বহমান। এই বহমান জীবনের সব গল্পই সবার জানা থাকে, এমনটা নয়। তবু জানার আগ্রহ বা জানতে বাধ্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কেবল শত শত মহাকাব্যের জন্ম দেয়। এ দেশেও তেমনই এক মহাকাব্যের নাম সাকিব আল হাসান।

বলা হয় বাংলার প্রাণ সাকিব আল হাসান। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ ছোট্ট ভূখণ্ডে হাজারো সাকিবের জন্ম হয়েছে কিংবা ভবিষ্যতেও হবে। কজন সাকিবকেই আমরা মনে রেখেছি। কিংবা কজনকেই আমাদের মনে রাখতে হয়েছে। কজনইবা পেরেছে সাফল্যের প্রতিটি সিঁড়িকে জয় করে সাকিবের মতো অসাধারণ পথ চলতে। শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না, বরং মানসিক শক্তির অসীমতাকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের মনে জায়গা নিয়ে তিনি লিখেছেন মহাকাব্য। বসেছেন ভালোবাসা নামক পর্বতের চূড়ায়।


জীবন অবসানের দ্বারা হারিয়ে যাওয়া হাজারো সাকিবের মধ্যে এ সাকিবইবা কেন সবার থেকে আলাদা। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বছরের পর বছর গবেষণার দরকার নেই। দরকার নেই অতিথি পাখির মতো বেঁচে থাকার জন্য হাজার মাইল পাড়ি দেওয়ার।
দেশের ক্রিকেটরাজ্যের এই রাজপুত্রকে সবাইকে চিনিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। যিনি তাঁর ২২ গজের যুদ্ধে বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, এ বঙ্গে সাকিব একজনই। যাঁর সফলতায় এপার বাংলা হাসে, যাঁর ব্যর্থতায় সমান বিষাদে দুঃখী হয় ওপার বাংলার ময়নার প্রিয়জনেরা।
সাকিব নামক স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। দীর্ঘ ৩৫ বছরে যে স্বপ্ন এখন ঠাঁই নিয়েছে প্রতিটি ঘরে ঘরে, প্রতিটি পাড়ায়। কে জানত মাগুরার সেই ছোট্ট ছেলে একদিন বিশ্বকে জানান দেবে পদ্মাপাড়ের মানুষও পিছিয়ে নেই। তারাও জানে কীভাবে সংগ্রাম করতে হয়। বাংলার দামাল ছেলেরা যেভাবে সংগ্রাম করে ছিনিয়ে এনেছিল দেশের স্বাধীনতা, এনেছিল লাল–সবুজ পতাকা, পৃথিবীর বুকে জেগে উঠেছিল আরও একটি নতুন ভূখণ্ড। ঠিক সেভাবেই বুকে বারুদের বাসা নিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের সাকিব।
সাকিব শব্দটার পেছনে যতটা লুকিয়ে রয়েছে মাহাত্ম্য, ঠিক ততটাই জ্বলজ্বল করছে ভালোবাসা। তবুও যে মাঝেমধ্যে মুদ্রার বিপরীত পিঠটাও দেখতে হয়। প্রচণ্ড ভালোবাসার তীব্র ঢেউকে সঙ্গী করে ছুটে চলা তরিকে থামতে নেই, থামতে যে হয় না। হোঁচট খেতে হয়। হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে দৃঢ়চিত্তে প্রবল আত্মবিশ্বাসে আবারও উঠে দাঁড়াতে হয়। সাকিবও তাই, ভেঙে যায়, তবু মচকায় না। তিরস্কার কিংবা ব্যর্থতা, যা–ই বলি না কেন, স্বপ্নকে তাড়া করে ছুটে চলার মধ্যে দেশকে ভালোবেসে হৃদয় নিংড়ে দেওয়ার প্রতিদান তাকে দিতেই হবে।

সাকিব নামক অসমাপ্ত মহাকাব্যের অবসান কোথায় হবে কেউ জানে না। তবে সময়ের পরিক্রমায় হয়তো নতুনদের ছেড়ে দিতে হবে স্থান। সাকিব নামক স্মৃতির ঝুলিতে হয়তো সাকিব একাই বাস করবে। শত শত বিভাজনের এই দেশে সাকিব নামের সেতু জোড়া লাগায় প্রতিটি ঘর, প্রতিটি আত্মাকে। কিছু সময়ের জন্য হলেও দুঃখ–সুখগুলোও মিলে যায় ক্রিকেট নামক তিন অক্ষরের শব্দে, ধ্বনিত হয় গোটা দেশ।

চ্যাম্পিয়নরা ২২ গজ জিতে যায়। তবে চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়নেরা থাকে হৃদয়ের মণিকোঠায়। তারা জানে পথটা কঠিন, হাল ছেড়ো না বন্ধু। যে গল্পের গন্তব্য হৃদয়ের অচিনপুর, তাকে আটকে রাখা যায় না। সেটা ক্রিকেট মাঠ বা হৃদয়ের মাঠ, যেখানেই হোক।

সাকিব কোনো স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা নয়, যাকে চার দেয়ালে আটকে রেখে সমালোচনার পাতায় বন্দী করে নির্লিপ্ত করা যায়। এ ইটপাথরের জাদুর শহরে ধুলোবালুর সঙ্গে সাকিবও উড়ে গিয়ে জড়িয়ে যাবে মনের অজান্তে। পোড়া মনের গোপন না চিনলেও সাকিব ঠিকই চিনবে। একজন সাকিবকে একনজর দেখার আনন্দ যখন সুদূর চীনের মহাপ্রাচীর কিংবা প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার অ্যাক্রপলিস পর্বতকেও হার মানায়, তখন দিন শেষে আপনাকে মানতে হবেই, সাকিবকে ভুল বোঝা যায়, ফেলে দেওয়া যায় না। তাই তো কবির ভাষায় বলতে হয়, ভালোবাসা সে তো বড্ড সেকেলে, কজনই বা পারেন সাকিবের মতো ভালোবাসতে বাধ্য করতে।

লেখক: রেজাউল ইসলাম রেজা, শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়