আমরা ক্লাসে ফিরতে চাই
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। এ অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম। সরকারের কিছু পদক্ষেপও প্রশংসনীয় ছিল এই অনলাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য। প্রয়োজনীয় ডিভাইস কিনতে ঋণ দেওয়া হয়েছে; যাঁরা অর্থাভাবে অনলাইনে ক্লাস করা যায়, এমন ডিভাইস কিনতে পারছিলেন না তাদেরকে। মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটকের উদ্যোগের কথা উল্লেখযোগ্য। বিডিরেন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অতি সামান্য খরচে অনলাইন ক্লাস করার সুবিধা দিয়েছে। অন্য অপারেটরগুলো জুম, গুগল মিট, গুগল ক্লাসরুম অ্যাপের জন্য অনলাইন ক্লাস প্যাকেজ চালু রেখেছে। তবে বাস্তবতার নিরিখে এসব সুবিধা অপ্রতুলতার কথা বলে। কারণ, এসব সুবিধা ব্যবহার করতে গিয়ে সামনে এসেছে মোবাইল নেটওয়ার্কের অবকাঠামোগত সমস্যা। যেমন নিরবচ্ছিন্ন উচ্চগতির নেটওয়ার্ক, ক্ষেত্রবিশেষে একেবারেই নেটওয়ার্ক কাভারেজবিহীন অবস্থা। সেটা শুধু টেলিটকেই নয় বরং বাকি সব কোম্পানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ঠিক এই নেটওয়ার্ক দুর্বলতার কারণে দেখা যায়, একটা ক্লাসের প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারে না। গ্রামাঞ্চলের দিকে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাভারেজ কখনোই ততটা শক্তিশালী ছিল না, এখনো নয়। উদাহরণ হিসেবে আমার সহপাঠীদের কথা বিবেচনায় নিলে সেটা খুব ভালো উদাহরণ হতে পারে। আমার ১০৫ সহপাঠীর মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ ৫০ জন সহপাঠী একদিন জুম সেশনে অংশ নিতে পেরেছিলেন। অন্যথায় ৩০ কি ৪০ জনের বেশি না। এভাবে ক্লাসের অর্ধেকের বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীই শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে আছে।
সঙ্গে যদি যুক্ত করি আমাদের আর্থিক দুর্বলতার কথা। তবে সেটাও একটা নাজুক পরিস্থিতির অবতারণা করবে। কারণটাও খুব স্পষ্ট, করোনার দরুন বিভিন্ন সময় লকডাউনের প্রভাব সাধারণ মানুষের আয়–রোজগারেও পড়েছে। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, হতদরিদ্র পরিবারগুলোর অবস্থা তথৈবচ। আমাদের অর্ধেকের বেশিসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এসব পরিবার থেকেই উঠে এসেছেন। তাই অনেক শিক্ষার্থীই বর্তমান এই পরিস্থিতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে বেছে নিচ্ছেন আয়–রোজগারের বিভিন্ন পথ। তাঁদের আবারও ক্লাসে ফিরে আসাটা কতটা সম্ভব জানি না। হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী সংখ্যার আসল পরিসংখ্যান সামনে আসবে।
সব মিলিয়ে অনলাইন ক্লাস সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ হিসেবে ধরা দিচ্ছে না। আমরা সঠিক শিক্ষা গ্রহণ এবং আমাদের শিক্ষক, বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি আলাপচারিতার সুযোগটি হাতছাড়া করছি। আমাদের লাইব্রেরি, সেমিনার লাইব্রেরিতে যাওয়ার সুযোগটিও হাতছাড়া হচ্ছে; যা আমাদের শিক্ষার অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করছে। আমরা অর্ধেকের বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীই জ্ঞানের ঘাটতি নিয়ে এক সেমিস্টার থেকে অন্য সেমিস্টারের পথে। এ কারণে আবারও যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে, তখন প্রতিটি ক্লাসের সবাইকে আবারও একই পাঠদানের আওতায় নিয়ে আসতেই হবে। নয়তো একই ক্লাসের, সেশনের উপ–সেশন তৈরি হবে। ইতিমধ্যে আমরা সেশনজট নামক শিক্ষাজটে আটকে রয়েছি সবাই। এরপর যদি এমন উপ-সেশন, উপ–ক্লাস তৈরি হয়ে যায়, তাহলে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি হবে নিশ্চিত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার এবং শিক্ষা কার্যক্রম পুরুদমে চালু করার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ধীরে ধীরে এগিয়েছে। মানে ধীরে ধীরে ছুটির সময় বাড়িয়েছে। এখনো বাড়ানো হচ্ছে সেই ছুটি। আবার পরিকল্পনাও হচ্ছে শিগগিরই ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়ার। আমাদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেটা আশাবাদী করে তুলছে। একটা চাওয়া, সেটা যেন একটা কচ্ছপগতির প্রকল্প না হয়। তাতে আমাদের ক্লাসে ফেরার অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত হবে। এই অপেক্ষা আমাদের কাছে গলার কাঁটা স্বরূপ। আমরা ক্লাসে ফিরে যেতে চাই যত দ্রুত সম্ভব।
লেখক: মঈনুল হক খান, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।