আফিফের লাল জামা

মৃতপ্রায় নগর। মানবশূন্য নগর। লাশের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে। সবাই চাচ্ছে নগরটা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক। চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকতে থাকতে মানুষ এখন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। অসুস্থ নগরে বসবাস করা খুবই কষ্টকর। পুরো শহরে লকডাউন। ঘরের বাইরে লকডাউন, ঘরের ভেতর লকডাউন। মধ্যবিত্ত পরিবারের পকেটেও লকডাউন।
কিছুদিন পরই ঈদ। শিশুদের চোখে নেই নিঁদ। আমার ছেলে আফিফ। দুই মাস ধরে বায়না ধরে আসছে, ‘বাবা, এই ঈদে কিন্তু আমায় চার-চারটি লাল জামা কিনে দেবে।’ আমি ওর নাক টিপে বলি, ‘এত্ত জামা দিয়ে তুমি কী করবে, হ্যাঁ?’

ও মুচকি হেসে বলে, ‘তোমাকে পরে বলব। এখন প্রমিজ করো, তুমি কিনে দেবে!’
‘হুম। অবশ্যই দেব। আমার বাবাকে চারটা লাল জামা কিনে দেব।’

আমার কথা শুনে সে খুশিতে আটখানা। চেহারায় ঈদের আনন্দের হাসি। এই হাসি আমি ভীষণ ভালোবাসি!

আমার অফিসের টেবিলে একগাদা কাজ জমে ছিল। রাত-দিন এক করে কাজগুলো আজ শেষ করলাম। অফিসের বস দুই মাস ধরে বেতন দিচ্ছেন না। গত দুই মাসে বসের কাছে পাঁচবার গিয়ে বলেছি, ‘স্যার লকডাউনে পকেটের....।’ বাক্যটা শেষ না হতেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘দ্যাখছো না, অফিসের অবস্থা!’

গলা পরিষ্কার করে বললাম, ‘অফিসের অবস্থা তো মাশাল্লাহ ভালোই। সবাই কাজ করছে। অফিসও চলছে, আগের মতোই। কোনো সমস্যা তো দেখছি না।’

‘তুমি কী বুঝবে এসবের? যাও। গিয়ে কাজ করো। বেতন ঠিক সময়ে পেয়ে যাবে।’
নিজের টেবিলে এসে বসতে বসতে ভাবলাম, বসের ঠিক সময় কবে আসবে কে জানে?
হয়তো পুরো শহর সুস্থ হলে দেবে। কবে যে সুস্থ হবে কে জানে!

ঈদের আগের রাত। চাঁদনি রাত। আকাশে চাঁদ-তারা খেলা করছে। আগামীকাল ঈদ। ঈদের খুশি পৃথিবীজুড়ে।

আমি চেয়ার পেতে বারান্দায় বসে আছি। আফিফের মা আফিফকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। ও খাবার মুখে নিচ্ছে না।

আফিফের চেহারা আমার কাছে চাঁদের মতো লাগছে। কিন্তু ভীষণ বিষণ্ন দেখাচ্ছে। চাঁদটা ঈদের খুশিতে কী সুন্দর হাসছে। অথচ আফিফের চেহারা হাসছে না।

ওর মায়ের এক হাতে খাবারের প্লেট। অন্য হাতে ভাতের লোকমা। আফিফের মুখের সামনে ধরে আছে।

আমার মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য এটি। আমি তাকিয়ে আছি। আমার সঙ্গে দূরের চাঁদটাও তাকিয়ে আছে।

আফিফের মা বলছে, ‘বাবার মতোই জেদ হয়েছে ছেলেটার।’

হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠল। বসের নম্বর। ধরতে ইচ্ছা করছে না, তবুও ধরলাম। বস ও পাশ থেকে বললেন, ‘ফুয়াদ সাহেব, আপনার সঙ্গে সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি খুবই লজ্জিত। আসলে সেদিন...’

‘স্যার, কী যে বলেন না! আমি সেদিনের কিছুই মনে রাখিনি। আমারই ভুল হয়েছে। সেদিন আপনার কাছে যাওয়া উচিত হয়নি হয়তো।’ তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘আচ্ছা, আপনি এত ভালো ক্যান হ্যাঁ? আমাদেরও একটু ভালো হতে দেন না!’ মিনিট দুয়েক পর আপনার অ্যাকাউন্টে বেতন ও ঈদের বোনাস যাবে। প্লিজ গ্রহণ করবেন। খুশি হব।’

আফিফ আমার ডান হাতের আঙুল চেপে ধরে হাঁটছে। ওকে ভীষণ খুশি খুশি লাগছে। সবার জন্য কেনাকাটা করলাম। আফিফকে চার-চারটি ‘লাল জামা’ কিনে দিয়েছি। সে হাঁটছে আর একটু পরপর শপিং ব্যাগের ভেতর দেখছে। সব ঠিকঠাক আছে কি না! আফিফ তিনটি পথশিশুর হাতে লাল জামা তুলে দিয়ে বলল, ‘আগামীকাল সকাল সকাল জামা পরে আমাদের বাসায় আসবে। আমরা একসঙ্গে ঈদগাহে যাব।’ বিভিন্ন বাড়ির ছাদ থেকে শিশুদের হইচই ভেসে আসছে। আমি শিশুদের আনন্দ দেখে বলে উঠলাম, ‘ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবার ঘরে, ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি হোক সবার তরে!’

*লেখক: মনজুর সা’দ, কসবা, শেরপুর