আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু: ত্যাগী রাজনৈতিক ও সফল ব্যবসায়ী
মুক্তিযোদ্ধা বরেণ্য শিল্পপতি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বললেও কম বলা হবে, বলতে হবে একটি বটবৃক্ষ। বেসরকারি ব্যাংকিং জগতের সফল পুরুষ ও প্রদর্শক ছিলেন তিনি। জয় করেছিলেন সাধারণ মানুষের মন। ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের। শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন আবালবৃদ্ধবনিতাসহ ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-ব্যাংকারদের। আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় অবস্থান দৃঢ় করেছেন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের প্রতি।
১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী। পিতা নুরুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন আইনজীবী। মা খোরশেদা বেগম। ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ওই বছরই ঢাকা নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়ালেখা করেন। সেখান থেকে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন। ১৯৬৫ সালে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর মরহুম আলহাজ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় মেয়ে নুর নাহান জামানকে বিয়ে করেন।
স্বাধীনতার আগে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাটালি রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যান আম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট ক্রয় করে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জামান শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল কিনে নেন। তিনি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবিএল) উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি দুই দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন আখতারুজ্জামান চৌধুরী। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার পাথরঘাটা জুপিটার হাউস থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তাঁর বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিও) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি বাহাত্তর সালের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী।
স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে আখতারুজ্জামান চৌধুরী সাংসদ নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। শুধু রাজনীতিই নয়, তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতার আগে তিনি বাটালি রোডে বয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে আখতারুজ্জামান চৌধুরী আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যানআম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট কিনে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দুই দশকে জামান শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। বেসরকারি ব্যাংকিং খাত প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশে বেসরকারি ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবিএল) উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
২০১১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র এবং ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দুই দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী সমাজহিতৈষী, দানবীর ও জনদরদি ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়ায় বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এ ছাড়া বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারাবরণও করেন। রাজনীতি করতেন মাটি আর মানুষের সঙ্গে। সমাজসেবক ও দানবীর হিসেবে নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি পরিবারের সুখ-দুঃখে তিনি পাশে দাঁড়াতেন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরীর তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বর্তমানে আনোয়ারা-কর্ণফুলী আসনের সাংসদ ও ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। মেজ ছেলে আনিসুজ্জামান চৌধুরী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) ইসি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ছেলে আসিফুজ্জামান চৌধুরীও একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।
লেখক: এআইজি (প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসার্চ-১), বাংলাদেশ পুলিশ ও সাবেক শিক্ষার্থী হাইলধর বশিরুজ্জামান স্মৃতি শিক্ষা কেন্দ্র।