হাসপাতালে আইসিইউ বেডের হাহাকার সত্যি দুঃখজনক

ফাইল ছবি

দেশে করোনাভাইরাস এবার এসেছে সুনামির মতো। প্রতিদিন চেনাজানা আর আপনজনদের মৃত্যুর খবর শুনে বড় অসহায় লাগে নিজেকে। যার ঘরে করোনা হানা দেয়, সে বুঝে এর ভয়াবহতা কতটা বেদনার। আর বিগত বছরের হাসপাতালের অভিজ্ঞতা মনে হলে নিজের অসহায়ত্ব বোধটা কুরে কুরে খায়। ইচ্ছা করলেই স্বজনেরা রোগীর কাছে যেতে পারেন না। আইসিইউর সামনে নির্বাক হয়ে দিনরাত পার করতে হয়। কাউকে কিছু বলার নেই। লাখ লাখ টাকাও অর্থহীন হয়ে পড়ে এ অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে। একটু অক্সিজেনের আশায় মানুষের আকুলতা সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়।

গত বছরের তুলনায় এ বছর করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার অনেক বেশি। কিন্তু মানুষের কাছে এ ভাইরাস বা মৃত্যু এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। আসলে করোনার সঙ্গে মানুষ বসবাসে অভ্যস্ত হতে পেরেছে খুব তাড়াতাড়ি। হয়তো এটাকে প্রকৃতির বিধান বলে মেনে নিয়েছে। তবে সবকিছুর একটা মাত্রা থাকা প্রয়োজন আছে৷ যে রোগটা পৃথিবী থেকে চলে যায়নি, তা যেন আবার দেশে হানা দিতে না পারে তার জন্য সচেতন থাকাটা খুব জরুরি ছিল। দুঃখজনক হলো মানুষ নিয়ম মানতে নারাজ। রাজনৈতিক, সামজিক সমাবেশ, উৎসব—কোনো কিছুর কমতি ছিল না সাত–আট মাস ধরে।

এখন প্রশ্ন হলো হঠাৎ মার্চের শেষ দিকে এত দ্রুতগতিতে রোগের হার বাড়ার কারণ কী? জানুয়ারি থেকেই স্বল্প হারে রোগ বাড়ছে তা চিকিৎসকেরা বলে এলেও সে বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি জনগণ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মানসিকতা যে জনগণের নেই, তা সবারই জানা। এ ক্ষেত্রে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল সরকার ও প্রশাসনের। আজ যে লকডাউনের কথা আসছে, তা যে স্থায়ী সমাধান নয়; তা প্রমাণিত। এ লকডাউনে আর্থিক সংকট তৈরি হবে।

করোনা টিকা
ফাইল ছবি

অন্যদিকে রোগ নিয়ে এখন বেসামাল পরিস্থিতিতে আছে দেশের হাসপাতালগুলো। আইসিইউ বেড সংকট অতীতেও ছিল, এখনো আছে। সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনা পরিস্থিতি যাচাই করে এ দেশের হাসপাতালগুলোতে করোনাসংকট সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি না নেওয়াটা অস্বাভাবিকই বটে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ নতুন ছিল বলে সরকার ও জনগণের অনেক সমস্যা বুঝে উঠতে সময় লেগেছে। কিন্তু এ বছর আইসিইউ নিয়ে মানুষের হাহাকার মেনে নেওয়া যায় না। করোনাকে মোকাবিলার জন্য সরকারের বরাদ্দের কমতি নেই। তাহলে আইসিইউ, হাই ফ্লো নাজাল অক্সিজেন–ব্যবস্থার দিকে নজর না দেওয়ার ব্যর্থতা কার, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।

পরিবারের একজন করোনায় আক্রান্ত আপনজনকে নিয়ে আইসিইউর জন্য হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ছুটে বেড়ানোর যন্ত্রণা শুধু খবরের পাতার খবর নয়। এটা মানবিকতার কাছে পরাজিত মানুষের লজ্জা।

যার চলে যায়, সে–ই বোঝে বিচ্ছেদের কী যন্ত্রণা! ২০২০ সালে করোনায় যে পরিবারগুলো স্বজন হারিয়েছে, তাদের শুধু একজন মানুষ চলে যায়নি। বরং তাদের পরিবারে সব দিকে শূন্যতা নেমে এসেছে। তাই সে জায়গায় দাঁড়িয়ে একবার ভাবুন, আইসিইউর সংখ্যা না বাড়িয়ে কিংবা বেসরকারি–সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী না করার ফল কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে এ মুহূর্তে সরকার ও জনগণের জন্য। করোনার টিকা এ রোগের একটা সমাধান তা প্রমাণিত। তবু দেশের সব মানুষকে নিজ স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত। চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বের উন্নত দেশও হিমশিম খাচ্ছে, এ উদাহরণ দিয়ে পার পাওয়ার চেয়ে নিজের সাধ্যের মধ্যে মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিলে হয়তো হাসপাতালের বেড ও আইসিইউ নিয়ে এখন এতটা হাহাকার হতো না। মানুষকে প্রতিদিন তীর্থের কাকের মতো একটা আইসিইউর বেডের জন্য অপেক্ষায় প্রহর গুনতে বা ছেলের সামনে মায়ের মৃত্যু হতো না অ্যাম্বুলেন্সে।

*লেখক: হাসিনা আকতার নিগার, কলামিস্ট