সেন্ট মার্টিনে তিক্ত অভিজ্ঞতা

স্বচ্ছ নীলের সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের আনাগোনা এখন বেশি
ছবি: লেখক

দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট। জাহাজের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে তখন দূর থেকে চেয়ে আছি সামনের সবুজ আবহের দিকে। স্বচ্ছ নীলে জড়ানো সেন্ট মার্টিনকে বইয়ের পাতায় কিংবা পত্রিকার প্রচ্ছদে দেখে এসেছি কতকাল। এই প্রথম সেই মুগ্ধকর নীলের দেখা পাব। আমার হাতে রাখা ক্যামেরা তাক করে রাখলাম দূরের অধরা সে দ্বীপের দিকে। এতক্ষণ আমাদের পথ দেখাচ্ছিল যে গাঙচিলের দল, তারা পাশ ছেড়ে ফিরে গেছে ততক্ষণে। পানির রঙে সবুজের আবহ চলে এসেছে। সবার চোখেমুখে অপেক্ষার ঢেউ।

সব অপেক্ষাকে পেছনে ফেলে পা রাখলাম জেটিতে। মানুষের ভিড় ঠেলে অল্প পথ এগোতেই লেগে গেল বেশ খানিকটা সময়। ভিড়ের মধ্যে তখন মুক্ত বাতাস খুঁজে চলাই মুখ্য হয়ে উঠল স্বচ্ছ নীল পাওয়ার চেয়ে। অল্প বয়সী ছেলের দল ব্যাগ আনা–নেওয়ার কাজে ব্যস্ত। প্রকৃতিতে বসন্ত এসে গেলেও দ্বীপের গায়ে যেন শীত লেগেই আছে।

সেন্ট মার্টিনে মুগ্ধতার মধ্যও স্বচ্ছতা খুঁজে পাওয়া যায় না
ছবি: সংগৃহীত

সত্যি বলতে, সেন্ট মার্টিন আমাকে যতটা না মুগ্ধ করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে বিষণ্ন। এর পেছনে সময়কে দায়ী করব কি না, জানি না। তবে যে স্বচ্ছ নীলে চোখজুড়ানোর আশা নিয়ে ভ্রমণ শুরু করেছিলাম, কোথাও সেই স্বচ্ছতাকে খুঁজে পেলাম না। নারকেল জিঞ্জিরা থেকে শুরু করে প্রবাল দ্বীপ, এখানকার স্থানীয় মানুষের এলাকার দিকটাও ঘুরে দেখে এলাম। না পেলাম সেই নীল, না পেলাম সে স্বচ্ছ জল। সাগরও যেন বিষণ্ন চোখে আমাদের দেখা দিল। যাওয়ার পথটা যতখানি আনন্দের উচ্ছ্বাস নিয়ে বুকের ওপর আছড়ে পড়ছিল, পৌঁছার পর সাগরের বিষণ্ন মুখে তা অস্ত গেল।

গল্পের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের সমুদ্র বিলাস দেখতে গিয়ে পাওয়া গেল ভাঙা টিনের সামনে বড় করে লেখা ‘এটা আমার হাঁটার রাস্তা ছিল’
ছবি: লেখক

খুব ইচ্ছা ছিল গল্পের জাদুকরের (হুমায়ূন আহমেদ) সমুদ্র বিলাস দেখার। দ্বিতীয় দিন বিকেলের দিকে গেলাম সেদিকটায়। দেখতে পেলাম এক ভাঙা টিনের সামনে বড় করে লেখা ‘এটা আমার হাঁটার রাস্তা ছিল’। তারপর সামনে সে পথ ধরে যত দূর গেলাম, জাদুকরের ফেলে রাখা স্মৃতির প্রতি অবহেলা যেন ততই বড় করে চোখে ধরা দিল। ভেতরে ঢোকা নিষেধ। বাইরে থেকেই দেখতে পেলাম ভেতরের টিনের চালের ঘরগুলোর পেছন দিকটা ভেঙে আসবাবপত্র অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। এগুলো যতই দেখলাম, ততই অনুভব করতে পারলাম, আমরা হুমায়ূন আহমেদকে অনেক করে ভালোবাসা দিলেও যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারিনি।

ফেরার পথে জাহাজে এতটা ভিড় জমে যায় যে দাঁড়ানোর মতো জায়গা পর্যন্ত থাকে না। আরেক জাহাজের যাত্রীদের বেশির ভাগ এসে উঠে পড়ায় এমন উপচে পড়া ভিড়। ওই জাহাজ নাকি যাত্রীদের না নিয়েই রওনা দিয়ে দেয়। বিপাকে পড়ি আমরা। সমস্ত সময় ওপেন ডেকে ঠেলাঠেলি আর ভিড়ের এক দমবন্ধ অবস্থায় কাটাতে হয়। এক বিদেশি দম্পতি আমার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায়। বেচারাদের দেখে খারাপই লাগে। হয়তো মনে মনে বেশ গালাগাল করতে থাকে এ দেশের মানুষদের।

সেন্ট মার্টিনে মুগ্ধতা আর বিষণ্নতা মিলিয়ে সময়টা ভালোই কেটে যায় পর্যটকদের
ছবি: লেখক

মুগ্ধতা আর বিষণ্নতা মিলিয়ে সময়টা ভালোই যায়। শুধু একটাই আক্ষেপ থেকে যায়—যে প্রকৃতি আমাদের মনে বারবার সুস্থতা ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে নিজেকে সুন্দর করে সামনে নিয়ে আসে, আমরা সে প্রকৃতিকেই অসুস্থ করে তুলছি।